স্টাফ রিপোর্টার : ১৯৭৫ থেকে ২০২০ পর্যস্ত এ দীর্ঘ ৪৫ বছর সময়ে বাংলাদেশে অনেক কর্মকর্তা কর্মচারিদের অনেক উন্নতি হলেও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মচারিদের তেমন কোন উন্নতি হয়নি। তাদের নিয়োগবিধি নেই, প্রমোশনও নেই, গ্রেড ও পরিবর্তন হচ্ছেনা। ফলে সারা দেশে সাড়ে ২৯ হাজার FPI-FWA দের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। এমন কি একই মন্ত্রনালয়ের কর্মচারিদের সাথে তাদের গ্রেডের এবং প্রমোশনের বৈষম্য রয়েছে। যে পদে তারা চাকুরি গ্রহন করছেন, সেই পদ থেকেই হয় পেনশন, না হয় মৃত্যু। এ কর্মচারিদের দেখার এখন কেউ নেই। শেষ ভরসা তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান সময়ে মরণ ব্যাধি করোন ভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য সহকারিদের ২ সেট, কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপিদের ৪ সেট এবং পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকাদের ১সেট করে পিপিই দেয়া হয়েছে। কিন্তু FPI এবং FWA দের পিপিই দেয়া হয়নি। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত FPI-FWAদের পিপিই কিছু কিছু জেলায় পৌছেছে বলে একটি সুত্র জানায়। পিপিই নিয়ে FPI-FWA দের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে এবং মাঠ পর্যায়ে কাজের ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। একই সময়ে একই স্থানে কেউ পিপিই পরিধান করে আর কেউ পিপিই ছাড়া কাজ করা সম্পূর্ণ অমানবিক। এনিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠ কর্মচারিরা অনেক উপজেলায় মুখামুখি অবস্থানে রয়েছেন। FPI-FWAরা সরকার ঘোষিত প্রনোদনা পাবেন কিনা তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
FPI ও FWAগণ জানান, তারা নিজের কাজের পাশাপাশি সিসিতে তিনদিন দায়িত্ব পালন করে থাকেন, সিএইচসিপি না থাকলে পুরো সপ্তাহ সিসিতে কাজ করতে হয়। ইপিআই, স্যাটেলাইট ক্লিনিকে শিশুদের টিকা গর্ভবতী ও কিশোরীদের টিটি ইনেকজশন, পরিবার পরিকল্পনা ইনজেকশন প্রাথমিক স্বাস্থ্য শিক্ষা সহ সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে জনগনকে সচেতন করেন তারা। স্বাস্থ্য সহকারীগণ না থাকলে ভ্যাকসিন ক্যারিয়ার বহন করে FWA ও FPIগণ ইপিআই পরিচালনা করেন, এটা দীর্ঘ দিনের ইতিহাস। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের কোন কর্মকর্তা কর্মচারি পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কাজ করা দূরে থাক-একটি কথাও কোন দিন বলেননি। কর্মকর্তাগণ কাজ করানোর সময় FPIদের বলেন আপনি ইউনিয়ন ম্যানেজার, সব সফলতা আপনার। FWAদের বলা হয়, আপনি টিকা ও ইনজেকশন দিতে পারেন, তাই আপনারা টেকনিক্যাল পারসন হবেন। কিন্তু যখন প্রমোশন, টেকনিক্যাল পদমর্যাদা এবং গ্রেড পরিবর্তন চাওয়া হয়, তখন উর্ধতন কর্মকর্তারা বলেন এটা সরকারের বিষয়। সুত্র মতে স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগের আগ থেকেই FPI- FWAগণ ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, যক্ষা, কুষ্ঠরোগ, কালাজ্বর, গুটিবসন্ত, জলবসন্ত, ম্যালেরিয়া সহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে কাজ করেছেন। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন উপজেলার কর্মকর্তারা কর্মচারিদের বলছেন মাঠে কাজ করতে আর সাধারণ মানুষ দেশের অনেক স্থানে কর্মচারীদের ভাইরাস ছড়ানোর আশংকায় বাসা বাড়ি ও গ্রামে ডুকতে দিচ্ছেনা। এতে কর্মচারিরা বিপাকে পড়েছেন। অনেক উপজেলা ইউনিয়নের করোনা প্রতিরোধ কমিটির সদস্য হয়ে প্রবাসি ও করোনা সন্দেহের তথ্য আদান প্রদানে ছুটাছুটি করছেন FPI-FWAগণ ।
FWAগণ অভিযোগ করেন, একসময় তাদের ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে নরমাল ডেলিভারি করতেন। এতে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এ প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং হাসপাতাল ক্লিনিকে সিজারিয়ান ডেলিভারির রমরমা ব্যবসা শুরু হয়। যে ডেলিভারি নরমাল হওয়ার কথা, টাকার লোভে সেই ডেলিভারিও সিজারিয়ান করা হয়। এমন সংবাদ গণমাধ্যমে বারবার প্রকাশিত হয়েছে। একথা সত্য যে, পরিবার পরিকল্পনা কর্মচারিদের সফল কাজের জন্য বাংলাদেশে আজ উন্নয়নের রোল মডেল। বলা হয়ে থাকে FPI-FWAদের নিয়োগ বিধি না থাকায় তাদের গ্রেড পরিবর্তন ও প্রমোশন হচ্ছে না। অথচ জাতীয় একটি কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ বিধি ছাড়াই গ্রেড পরিবর্তন করা যায়। নিয়োগবিধির দায়িত্বও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে। ১৯৯৪ ও ২০১৫ সালে দুইটি নিয়োবিধি প্রণয়ন করা হলে ত্রিশ হাজার FPI-FWAদের নিয়োবিধি রহস্যজনক কারণে করা হয়নি। বর্তমানে নিয়োগবিধির কাজ কিছু অগ্রসর হলে সম্পূর্ন শেষ হয়নি। গ্রেড পরিবর্তন ও প্রমোশনের আশায় ইতিমধ্যে অধিকাংশ সিনিয়র কর্মচারী পেনশনে যাচ্ছেন, কেউ কেউ সারাজীবন কাজ করে হতাশা নিয়ে মৃত্যুবরণও করছেন।
এমন করুণ পরিনতি একমাত্র FPI-FWA ছাড়া কোন কর্মচারির কপালে নেই। একটি দায়িত্বশীল সুত্রমতে এক সময় পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম ছিল এবং অনেকে এ বিভাগে চাকরি করতে অনীহা প্রকাশ করতেন। এখন অবশ্য উপজেলা, জেলা এবং অধিদপ্তর পর্যন্ত প্রায় অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ন পদই ডাক্তারদের দখলে। পদায়নে কেউ কেউ রাজনৈতিক আশ্রয়ে বড় পদও পেয়েছেন। এ বিভাগে ক্যাডার, নন-ক্যাডার, টেকনিক্যাল, নন টেকনিক্যাল দ্বন্ধের কারণে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে FPI-FWA তথা মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। কর্মচারীরা বলছেন শনিবার অধিদপ্তর বিভাগ জেলা উপজেলা অফিস বন্ধ থাকলেও সরকারি ছুটির দিনেও স্বাস্থ্য বিভাগের কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করতে হয় FPI-FWAদের। সিএইচসিপিগণ ১৪তম গ্রেড স্বাস্থ্য সহকারীগণ ১৫তম গ্রেডে আছেন। কিন্তু যে FPI তাদের তদারকি করেন সেই FPIএর গ্রেড ১৬তম। কি বিস্ময়কর বিষয়! FWAগণ তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে চাকুরি গ্রহন করলেও এখন ১৭তম গ্রেড করে চতুর্থ শ্রেণী করে রাখা হয়েছ। ১৯৯৪ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সরকারী শিক্ষকদের সাথে FPI ও FWAদের বেতন স্কেল সমান ছিল। ইউনিয়নের কৃষি বিভাগের বক্ল সুপারভাইজারদের দ্বিতীয় শ্রেনীতে উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র FPI-FWAদের গ্রেড পরিবর্তন ও প্রমোশন হচ্ছে না। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নবাগত মহা পরিচালক সাহানারা বানু মোবাইল ফোনে এই প্রতিনিধিকে জানান, প্রয়োজনুসারে পিপিই দেওয়া হচ্ছে, শনিবারে ছুটির দিন কর্মচারীদের খোলা রয়েছে এ বিষয়ে তিনি অবহিত আছেন, গ্রেড পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইলের লাইন কেটে যায়। পরে সংযোগ পাওয়া যায়নি। বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম নুনু মিয়া জানান, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের FPI ও FWAদের নিয়োগবিধি, প্রমোশনের ব্যবস্থা এবং উপযুক্ত গ্রেড প্রদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমি জোর দাবি জানাচ্ছি। সিলেটের উত্তর কুশিয়ারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আহমদ জিলু বলেন, ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠ কর্মচারিরা জীবনের ঝুকি নিয়ে মাঠে কাজ করছেন। আমার ইউনিয়নের সবাইকে নিয়ে নিজেই মাঠে কাজ করছি। তাই বাংলাদেশের সাড়ে ২৯ হাজার FPI-FWAদের গ্রেড পরিবর্তন ও প্রনোদনার বিষয়টি বিবেচনায় আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি কামনা করছি।
কক্সবাজারের মুক্তাগাছার FPI ফারুক আহমদ, ধামরাইয়ের হাবিবুর রহমান, চাঁদপুরের আমির হোসেন নয়ন, ময়মনসিংহের আতিকুজ্জামান সুমন, হবিগঞ্জের কামাল আহমদ, কক্সবাজারের ইছহাক আহমদ, পটুয়াখালির কামাল আহমদ, সিলেটের কানাইঘাটের আব্দুল বারি, সুনামগঞ্জের FWA রেশফা আক্তার, কমলগঞ্জের নিয়তি সিনহা সহ অনেকেই এই প্রতিনিধির সাথে তাদের চাকুরী জীবনের অবহেলা, বঞ্চনা, হতাশা এবং অসন্তোষের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকঠ একমাত্র ১১ ও ১২ তম গ্রেড প্রদানের দাবি করেন এবং মাত্র মৃত্যু, শিশু মৃত্যু রোধে পূণরায় ৬ মাসের প্রশিক্ষণ চালু এবং উপযুক্ত প্রনোদনা প্রদানের দাবি জানান।
মহেশখালি উপজেলার মাতার বাড়ি ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে কর্মরত সিএসবিএ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত FWA সুলতানা বেগম জানান, এপ্রিল মাসে করোনা ভাইরাস আতংকের মধ্যে ৩৪টি নরমাল ডেলিভারি করেছেন। তিনি দাবি করেন, FWAদের ৬ মাসির প্রশিক্ষণ দিয়ে ডেলিভারির সুযোগ করে দিলে বাংলাদেশে মাতৃ মৃত্যু, শিশু মৃত্যু শুন্যের কোঠায় দাঁড়াবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাস্তবায়ন করতে চাই। তিনি সরকার ঘোষিত প্রনোদনা প্রদান এবং FPI-FWAদের ১১ ও ১২ গ্রেড প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করেন।