উম্মতে মুহাম্মদীর বড় নিয়ামত বিশ্বনবীর ‘মেরাজ, -এএইচএম ফিরোজ আলী

Uncategorized
শেয়ার করুন

আরবী ‘মেরাজ’ শব্দটি আরাজ শব্দ থেকে গৃহিত। আর আরাজ দ্বারা আত্মিক আরোহন বুঝায়। অন্যদিকে মেরাজ এর আভিধানিক অর্থ সিঁড়ি, সোপান, উর্ধ্বগমন, বাহন, আরোহণ, উত্থান প্রভৃতি। অন্য অর্থে উর্ধ্বলোকে আরোহণ বা মহামিলন, যা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বিশেষ মুজিজা (অলৌকিক ঘটনা)। নবী কুলের মধ্যে একমাত্র বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে এই অনন্য মর্যাদা প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও যুগান্তকারী ঘটনা হচ্ছে, ‘মেরাজ,। নবুয়াতের প্রমাণ স্বরূপ নবীদেরকে অলৌকিক কিছু প্রকাশ পেলে তাকে ‘মুজিজা, বলে। আমাদের প্রিয়নবী (সাঃ) অসংখ্য মুজিজা ছিল। তারমধ্যে মেরাজ গমন একটি বিস্ময়কর মুজিজা। মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করার আয়াতের শুরুতেই মহান আল্লাহ ‘সুবাহানাল্লাহ, শব্দটি ব্যবহার করে মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ‘সুবাহানাল্লাহ, শব্দটি আশ্চর্যজনক ঘটনার সময়ই ব্যবহার করা হয়। মেরাজ যে সশরীরে হয়েছিল, তা বুঝাতে ‘আব্দুন’ শব্দও ব্যবহার করেছেন। আবদ বা বান্দা বলা হয়, রূহ ও দেহের সমস্টিকে। এ শব্দটিও রাসুল (সাঃ) এর মেরাজ সশরীরে হওয়ার প্রমাণ বহন করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে (নবী)কে রজনীযোগে ভ্রমন করিয়ে ছিলেন। মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশ আমি বরকতময় করেছিলাম, তাঁকে আমার নিদের্শনা দেখানোর জন্য নিশ্চয় তিনি সর্বাশ্্েরাতা, সর্বাশ্রষ্টা (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-১)। সহজ কথায় বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ঘটনাকেই শবে মেরাজ বলে।
সহিহ হাদিসের ভাষ্যনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ৫০ বছর বয়সে নবুয়তের দশম বর্ষে ৬২০ খ্রিষ্টাব্দের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে বিশ্বের সেরা মেরাজের বিস্ময়কর ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল। এ রাতে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) কাবা শরীফের চত্ত্বরে (হাতিমে) অথবা কারও মতে, উম্মে হানির গৃহে শায়িত ও নিদ্রিত ছিলেন। এ সময় ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) এসে মহানবী (সাঃ)কে ঘুম থেকে জাগালেন, অজু করালেন, সিনাছাক করালেন এবং বোরাকে চড়িয়ে বায়তুল মোকাদ্দসে পৌঁছালেন। সেখানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইমামুল মুরসালিন হিসেবে সব নবী-রাসুলদের নিয়ে তাঁর ইমামতিতে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করলেন। এরপর তিনি বুরাকে চড়ে সপ্তামাকাশে যাত্রা শুরু করলেন। প্রতিটি আকাশে অবস্থানরত পয়গাম্বরদের সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। প্রথম আকাশে হজরত আদম (আঃ), দ্বিতীয় আকাশে হজরত ইয়াহিয়া (আঃ) ও হজরত ঈসা (আঃ), তৃতীয় আকাশে হজরত ইউসুফ (আঃ), চর্তুথ আকাশে হজরত ইদ্রিছ (আঃ), পঞ্চম আকাশে হজরত হারুন (আঃ), ষষ্ট আকাশে হজরত মুসা (আঃ) এবং সপ্তম আকাশে হজরত ইব্রাহিম (আঃ) কে দেখতে পান। সকল নবী-রাসুলগণ হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে মোবারকবাদ জানিয়ে সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী বলে মোবারকবাদ জানালেন। হজরত মুসা (আঃ) তাঁর নিকট থেকে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) যাওয়ার পর হজরত মূসা (আঃ) কাদঁছিলেন। জিবরাইল (আঃ) তাঁকে কারন জিজ্ঞাসা করলে মূসা (আঃ) জানালেন কাঁদছি আমি এই কারনে যে, আমার উম্মত বেহেশত লাভকারীর সংখ্যা এ নবীর উম্মতের চেয়ে কম হবে। অথচ তিনি (নবী করিম সাঃ) বয়সের দিক থেকে যুবক এবং দুনিয়াতে প্রেরিত হয়েছেন আমার পরে।
তারপর মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) সবুজ রংঙের ‘রফরফ, পালকিতে চড়ে সপ্তামাকাশের উপর সিদরাতুল মুনতাহায় উপণিত হলেন। সেখানে ফেরেস্তা জিবরাইল (আঃ) থেমে গেলেন এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) একাকি রফেরফে চড়ে বায়তুল মামুর হয়ে আল্লাহর দরবারে পৌঁছালেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) লামাকাম লাজামান স্তরে পৌছানোর পর সেখানে নূর আর নুরের সৌরভে অভিভুত হয়ে যান নবী। মহানবী একটি পর্দার আড়াল থেকে মহান আল্লাহর সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে আল্লাহর দিদার লাভ করেন। সেখানে গিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) চারটি নদী দেখতে পান। দুটি নদী ভেতর দিকে আর দুটি নদী বাইরের দিকে প্রবাহিত। নদীগুলো সম্পর্কে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) জিরাইল (আঃ) জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি বললেন, ভেতরের দুটি নদী বেহেশত প্রবাহমাণ (সালসা বিল ও কাওসার) নামক দুটি নদী। বাইরের দুটি নদী হলো ভূপৃষ্টের মিশরের প্রবাহিত নীলনদ ও ইরাকে প্রবাহিত ফোরাত নদী বা তাদের নামের মূল উৎস। বায়তুল মামু পরিদর্শনকালে তথায় প্রতিদিন ইবাদতের জন্য সত্তর হাজার ফেরেস্তাকে দেখতে পান। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে হজরত জিবরাইল (আঃ) এর স্বরূপ দেখেন। এ সফরে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে কয়েকটি জিনিষ দেখানো হয়। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে দুধ ও মদের পেয়ালা দেখানো হয়েছিল। তিনি দুধ গ্রহণ করলেন। এটা দেখে জিবরাইল (আঃ) বলেছিলেন, স্বভাবগতভাবে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) দুধ গ্রহণ করেছেন। তারপর বললেন আপনি মদ গ্রহণ করলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেতেন। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখানো হয়। জাহান্নামীদের শাস্তিও দেখেছেন তিনি। জাহান্নামের দারোগা মালেককেও দেখেছেন। তাঁর চেহারায় হাঁসির কোন চিহ্ন নেই। মহান আল্লাহ যিনি নিজের সর্বশ্রেষ্ট ‘আবদ’ কে অর্থাৎ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদে হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। এখানে বিশ্বনবীর নাম মোবারকের স্থলে আল্লাহর বিশেষ ‘আবদ, বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যা মহান নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) একটি বিশেষণ। ‘আবদ, শব্দের অর্থ হলো বান্দা। এই ‘আবদ, শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘ইবাদত, শব্দ থেকে। ‘ইবাদত, অর্থ আল্লাহর বন্দিগী করা। রূহবিহীন দেহ আবদ নয় এবং দেহবিহীন রূহও আবদ নয়। কাজেই মেরাজের ক্ষেত্রে যখন মহান আল্লাহ তায়ালা আপন আবদকেই নিয়ে গেছেন বলে উল্লেখ করেছেন, তখন প্রমাণিত হয়েছে যে, নবীর রূহ ও দেহ উভয় নিয়ে মেরাজে গিয়েছিলেন।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর চাচা আবু তালেব ও স্ত্রী হজরত খাদিজা (রাঃ) ইন্তেকালের পর বিশ্বনবীর উপর অর্ত্যাচার, নির্যাতনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। এমতাবস্থায আল্লাহর নিদের্শনাবলী প্রত্যেক করিয়ে রাসুল (সাঃ) এর মনোবল চাঙ্গা করাটা ছিল মেরাজের অন্যতম উদ্দেশ্য। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন ‘পরম-পবিত্র ও মহিমাময় সত্ত্বা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমন করিয়ে ছিলেন, মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদের্শন দেখিয়ে দেই’(সূরা বনি ইসরাইল -১)। মেরাজের ঘটনা থেকে মুমিন খোঁজে পায়, সঠিক পথের দিশা, লাভ করে দ্বীনের বা ইসলামের উপর ঠিকে থাকার অবিচলতা। মেরাজের বিশ্বাসের কারনেই হজরত আবু বক্কর (রাঃ) সিদ্দিকী উপাধীতে ভূষিত হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে স্বীয় সান্নিধ্যে ডেকে নিয়ে উম্মতে মুহাম্মদিকে পুরস্কার স্বরূপ তিনটি বিশেষ উপহার প্রদান করেন। যা অন্য কোন নবীকে দেয়া হয়নি। যথা- ১। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, যা ফজিলতের দিক দিয়ে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমান। ২। সূরা বাকারাহ শেষোক্ত দুটি আয়াত, যেখানে এই উম্মতের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত ও অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে এবং ৩। উম্মতে মুহাম্মদির মধ্যে শিরককারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি রজব মাসের ২৭ তারিখে রোজা রাখবে, সে যেন ষাট মাসের রোজা রাখলো। হজরত আনাছ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি ২৭ রজব ইবাদত করবে তার আমল নামায় একশত বছরের ইবাদতের ছোয়াব লেখা হবে। এসব উম্মতে মুহাম্মদীর বড় এক নেয়ামত। আর তা অর্জন হয় বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মেরাজের মাধ্যমে।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *