ফারসী শব্দ ‘শব, অর্থ রাত, বরাত অর্থ ভাগ্য, সেই হিসেবে শবে বরাতের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ভাগ্যের রাত্রি। মহাফজিলত পূর্ণ ও বরকতময় রাত হচ্ছে ‘লাইলাতুল বরাত,। লাইলাতুল বরাতের অর্থ, মুক্তির রজনী। পবিত্র কোরআনে এ রাতকে ‘লাইলাতুল বারাকাহ, বা বরকতময় রজণী বলা হয়েছে। হাদিস শরীফে এ রাতকে ‘লাইলাতুল নিছফিমিন শাবান, তথা শাবানের মধ্য রজণী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর কাছে পাঁচটি রাত খুবই মর্যাদার। এই পাঁচটির মধ্যে শবে বরাতের রাতও রয়েছে। হাদিস শরীফে এসেছে-‘নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রির দোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন। (১) রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া, (২) শবে বরাতের দোয়া, (৩) শবে কদরের দোয়া, (৪) ঈদুল ফিতরের রাতের দোয়া, (৫) ঈদুল আযহার রাতের দোয়া। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত হচ্ছে. এ মহিমান্বিত বরকতময় রাত। সেই হিসেবে চলতি বছর ৯ এপ্রিল ২০২০ ইং ২৬ চৈত্র ১৪২৬ বাংলা ১৫ শাবান ১৪৪১ হিজরী বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে শবে বরাত পালিত হবে আমাদের দেশে। শাবান মাস আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাপূর্ণ। এ মাসকে রমজানের প্রস্তুতি মাসও বলা হয়ে থাকে। হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে, নবী করিম (স.) বলেছেন, শাবান মাস হলো আমার মাস, আর রমজান হল আল্লাহর মাস। হযরত মুহাম্মদ (স.) অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে বেশি নফল রোজা পালন করতেন। শবে বরাতকে বলা হয়, রমজানের মোয়াজ্জিন।
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, একরাতে আমি রাসুলুল্লাহ (স.) কে না পেয়ে তাঁর সন্ধানে বের হলাম এবং দেখলাম তিনি মদিনার জান্নাতুল বাকিতে কবরবাসিদের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছেন। নবীজি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে আয়েশা তুমি কি মনে কর, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.) তোমার উপর জুলুম করবেন? আমি বললাম-যে আল্লাহর রাসুল না আমি এমনটি মনে করিনা। তবে আমি ভেবেছিলাম, আপনি হয়তো, অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে গিয়েছিলেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, হে আয়েশা, আজকের রাত সম্পর্কে তুমি জেনে রেখো, মহান আল্লাহ এ রাতে দুনিয়ার প্রথম আকাশে দুনিয়াবাসির উদ্দেশ্যে নীচের আকাশে নেমে আসেন এবং যেসব বান্দা এ রাতে খাঁটি নিয়তে (অন্তরে) তাওবা করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, মহান আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। কোন প্রার্থনাকারি এ রাতে বঞ্চিত হননা। ইবনে মাজাহ শরীফের এক হাদিসে এ রাতের মর্যাদা ও ফজিলতের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, হযরত আলী (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যখন শাবানের মধ্যে রাত আসবে, তখন তোমরা সে রাতে কিয়াম তথা নামাজ পড়বে, রাত জেগে ইবাদত করবে এবং পরদিন রোজা রাখবে। কেননা শবে বরাতের দিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আকাশে এসে বান্দাকে, এই বলে ডাকতে থাকেন-আছ কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারি, যাকে আমি ক্ষমা করব। আছ কি কেউ রিজিক প্রার্থনাকারি, যাকে আমি রিজিক দিব, আছ কি কেউ বিপদ গ্রস্থ, যাকে আমি বিপদ থেকে উদ্ধার করব, এভাবে আল্লাহ ফজর পর্যন্ত তার বান্দাকে আহবান করতে থাকেন। পূর্ণময় এ রজনীতে অসংখ্য বান্দা-বান্দিকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ পাক যেমন মহান, তার ক্ষমাও তেমন মহান। তবে পরিপূর্ণ তাওবা ছাড়া এ রাতে কিছু লোকের গুনা মাফ করা হবেনা। যেমন : মুশরিক, হিংসুক, পিতা মাতার অবাধ্য সন্তান, মাদকাসক্ত, যাদুকর, গনক-ঠাকুর, হস্তরেখা দেখে ভাগ্য নির্ণয়কারি, জুয়াখোর, আত্নীয়তা বন্ধন ছিন্নকারি, গায়েবের সংবাদদাতা, অন্যায় ভাবে ট্যাক্স আদায়কারি, জালিম সৈনিক, ঢোল-তবলা হারমোনিয়াম বাদক, গায়ক, গায়িকা, বিদাতি ইত্যাদি।
বরকতময় এ রজনীতে তওবা ইস্তেগফার ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিমগ্ন থাকাই মুমিনের কর্তব্য। শবে বরাতের রাতে চলতি বছর জন্ম গ্রহণকারি আদম সন্তান এবং মৃত্যু বরণকারি আদম সন্তানদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এ রাতে আল্লাহ কালব গোত্রের (আরবের প্রসিদ্ধ গোত্র) যত ছাগল আছে, ঐ ছাগলের যত পশম আছে, তার চেয়ে বেশি বান্দাকে তিনি এ রাতে ক্ষমা করে দেবেন।
যেহেতু কালব গোত্রের ছাগলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল, তাই নবীজি তাদের ছাগলের পালনের কথা উল্লেখ করে শাবান মাসের এ মধ্য রজণীর গুরুত্ব বুঝিয়ে দেন। এ রাতে বেশি বেশি করে নফল নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা, দুরুদ শরীফ পাঠ করা, আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থাকা, আল্লাহর কাছে নিরবে অন্তর দিয়ে ক্ষমা প্রার্থমা করা, মাতা পিতা আপনজনদের কবর জিয়ারত করা, পাড়া প্রতিবেশি অসহায় দরিদ্রদের দান খয়রাত করা, মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করা ইত্যাদি। আয়েশা (রা.) বলেন, রমজান মাস ছাড়া রাসুলুল্লাহ (স.) কোন মাস সম্পূর্ণ রোজা রাখেননি বা সাবান মাসের চেয়ে বেশি রোজা অন্য মাসে পালন করতে দেখিনি। (সহিহ বোখারি ১৮৩৩, সহিহ মুসলিম ১৯৫৬,)। আরেকটি বর্ণনায় তিনি আরো বলেন, হযরত মুহাম্মদ (স.) অল্প কিছুদিন ছাড়া পূরো শাবান মাস রোজা রাখতেন। (সহিহ মুসলিম ১৯৫৭)। মুলত রোজা পালনই সাবান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করনীয়।
শবে বরাতে যেমন পালনীয় বিষয় আছে, তেমনি বর্জণীয় অনেক বিষয়ও বিদ্যমান আছে। এক সময় আমাদের দেশে শবে বরাতের দিন বিকালে জামাতের সাথে শত শত লোক কবর জিয়ারত করতেন। এখনও অনেক এলাকায় দল বেধে কবর জিয়ারত করতে দেখা যায়। সন্ধার সময় বিভিন্ন বাড়িতে, বিভিন্নস্থানে, বা মাজারে মোমবাতি জ্বালাতেন, সন্ধা থেকে রাত পর্যন্ত ফটকা ফোটানো বা আতশবাজি করতেন। বর্তমান সময়ে এসব একেবারে কমে গেছে এবং এসব ইসলামে সমর্থন করেনা। কিন্তু সিন্নি পোলাও আখনি মসজিদে বা মিলাদের পরে সিন্নি বিতরণ ও খাওয়া দাওয়া নিয়ে অনেক ঝগড়া ফসাদ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। শবে বরাতের এ রাতে বা শাবান মাসের এ চাঁদে মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিনদের খাওয়া দাওয়া ও দান খয়রাতের প্রচলন বিদ্যমান আছে। ইবাদতের বিগ্ন ঘটে বা অন্যের কোন সৎ কাজে বা ইবাদতে বাঁধা সৃষ্টি করা কাম্য নয়। সারা রাত জাগ্রত থাকতে গিয়ে ফজরের নামাজ যেন কাযা না হয় সেদিকে খুব খেয়াল রাখতে হয়। করব জিয়ারতের উত্তম পদ্ধতি হল, কবরস্থানের পশ্চিশ দিক থেকে পূর্বমূখি হয়ে গভীর রাতে একাকি কবর জিয়ারত করা উত্তম। মসজিদে সিন্নি বিতরণ ও খাওয়া দাওয়া নিয়ে হৈ-চৈ করা উচিৎ নয়। এ রাতে মসজিদে আলোক সজ্জা করা, হাক চিৎকার বা ঝামেলা করা এ রাতের পবিত্রতায় আঘাত হানে। যথাযথ মর্যাদা ধর্মীয় ভাবগম্ভির পরিবেশে আল্লাহর সন্তুষ্টি পালন এ রাতের মূল উদ্দেশ্য। মনে রাখতে হবে, শবে বরাতের রাত কোন উৎসবের রাত নয়। আমরা আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রর্থনা করব। বিশ্ব ব্যাপী বর্তমান সময়ে যে করোনা ভাইরাস নামক ব্যাধি আক্রমণ করেছে, আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে এ গজব থেকে মুক্ত করেন সেটাই আমরা প্রার্থনা করি। আমিন। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং শিরিয়ার কিছু এলাকায় ঘটা করে শবে বরাত পালিত হয়। তবে পবিত্র মক্কা মদিনা সহ আরব বিশ্বর কোথাও শবে বরাত পালন হয়না।
সম্পাদক
এ এইচ এম ফিরোজ আলী
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক