অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুনামগঞ্জের হাওর কন্যা ‘টাঙ্গুয়া’ এএইচএম ফিরোজ আলী

Uncategorized
শেয়ার করুন

বিশ্বের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি বাংলাদেশ। প্রকৃতি যেন দেশটিকে আপন মহিমায় সাজিয়েছেন। আবহমানকাল থেকে সবুজ, বন-বনানী, সুবিশাল হাওর-বিল, নদ-নদী, সমুদ্র-সমুদ্রসৈকত, দেশটাকে আকর্ষনীয় করে তুলেছে। প্রকৃতির এমন সম্পদের অঢেল রূপ অনেক অঞ্চলকে ঐশ^র্য ও লাবণ্যময় করেছে। সুনামগঞ্জের ‘হাওর কন্যা’ টাঙ্গুয়ার হাওর বিশ্বেরসুখ্যাতি অর্জন করেছে। মিঠাপানির বিশাল এ জলরাশি মৎস উৎপাদন, কৃষিতে সেচ, হাওর বিলাসিদের বিনোদন, সর্বোপরি পরিবেশ ও ভূ-মন্ডলের ভারসাম্য রক্ষায়, অন্যসব পানির উৎসবের মত প্রকৃতির এক বিশাল আর্শিবাদ। উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণী ও জীব-বৈচিত্র রক্ষা-সংরক্ষনে টাঙ্গুয়ার হাওরের ভূমিকা অতুলনীয়। টাঙ্গুয়ার হাওর সুন্দরবনের পর দ্বিতীয় ‘রামসার’। কথিত আছে যে, হাওরে এক সময় বাঁশের টং বানিয়ে কৃষক ধান পাহারা দিতেন। সম্ভবত সে কারণেই টং থেকে টাঙ্গুয়া নামকরণ হয়েছে।

ভাটিঅঞ্চল সুনামগঞ্জে হিমালয়ের পাদদেশে প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির এ জলাভূমি। হাওরটিকে নয় কুঁড়ি কান্দার, ছয় কুঁড়ি বিল নামেও ডাকা হয়। হাওরটির স্বচ্ছজল, সারি-সারি খরচ, জারুল, হিজল, নল-খাগড়া, সিংড়া, চাইল্যাবন, বৌলা, বনতুলসী, হুকল, সুজ্জারখাটা, ঝিরানি, লাল-সাদা শাপলাসহ ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ হাওরটিকে রূপের রানী করেছে। হাওরের মিঠা পানির মাছ, অতিথি পাখি এবং বণ্যপ্রাণী দেশ-বিদেশের পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এশিয়ার সর্ববৃহৎ টাঙ্গুয়ার হাওরকে দেশের ‘মাদার ফিসারী’ বলেও ডাকা হয়। ইকোট্যুরিজম মূলত হাওর ঘিরে বিচিত্র সৌন্দর্য ঝরনার জলরাশি, সোয়ামফরেষ্ট জীব-বৈচিত্র এ যেন অকৃত্রিম ভালোবাসার এক জলাভূমি।

টাঙ্গুয়ার হাওরকে মিটা পানির মাছ উৎপাদনের খনিও বলা হয়্। বন্যার সময় দুর-দূরান্ত থেকে ভেসে আসা মাছ হাওরে ঢুকলে আর ফিরে যেতে চায় না। হাওরে প্রায় বিলুপ্ত মাছ নানিন, রাণী, হিলইন সহ ১৪২ প্রজাতির মাছ, ১৩ প্রজাতির উভয়চর প্রানী, ৬ প্রজাতির বিলুপ্ত কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি,২১ প্রজাতির সাপ, ২৬ প্রজাতির বিভিন্ন বন্য প্রাণী এবং দেশি-বিদেশি পাখির অভয়ারন্য এ হাওর। ২০১৯ সালের পাখি শুমারিতে, ২০৮জাতের পরিয়া পাখি দেখা যায়। বিরল প্রজাতির পাখি প্যালাসেস সামুদ্রিক ঈগল, বড় আকারের প্যাকিংষ্টক পাখির বাস এ হাওরে। শকূন, প্রানকৌড়ি, বেসুনিকালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, পাতিহাঁস, টিকিহাঁস,স্কপহাঁস, গাঙচিল, শংখচিল, উদয়ীজিরিয়া, সাদাবক, কাইম, শারস, কাক, চিলসহ নানা জাতের পাখি বাস করে এ হাওরে। বিশে^ বিপন্ন হলেও বেয়ারের ভূতিহাঁস ৮টির মধ্যে ৫টিই দেখা যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে। ২০১২সালের জরিপে অধ্যাপক আলী রেজা খানের বর্ণনায় ২৫০ প্রজাতির পাখি, ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১ হাজার ২শ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০ প্রজাতির সরীসৃপ (সাপ), ১ হাজারের বেশি অমেরুদন্ডহীন প্রাণী বাস করে। টাঙ্গুয়ার হাওরে বিখ্যাত মাছ মহাশোল। হাওরটির বড় বৈশিষ্ট হচ্ছে, পানি স্বচ্ছ থাকায় গভীর পর্যন্ত হাওরের তলদেশ দেখা যায়।

হিমালয়ের উত্তরে মেঘালয়ের মনোমুগ্ধকর পাহাড়ের দর্শনীয় স্থান, টেকের ঘাটের পরিত্যক্ত চুনাপাথর প্রকল্প, নিলাদ্রি বারিক টিলা, যাদুকাটানদী, শাহ আরফিন (রহঃ) মাজার, আশ্রম, ইসকন মন্দির এবং বিলুপ্ত লাউড় রাজ্যের ধবংসাশেষ দেখতে পর্যটকদের ভীড় জমেই থাকে। রূপের রাণী যাদুকাটানদীর অগভীর চলন্ত প্রবাহমান জল সুইমিং দেখতে খুবই আকর্ষনীয়। সম্ভাবনাময় বিশে^র ঐতিহ্যের টাঙ্গুয়ার হাওর সহ অসংখ্য হাওর-বিল-ঝিল বেষ্টিত সুনামগঞ্জকে বলা হয় ‘হাওর কন্যা সুনামগঞ্জ’।

সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দুরে তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। শ্রীপুর উত্তর, শ্রীপুর দক্ষিণ, বড়দল উত্তর ও বড়দল দ্িক্ষণ- এ চারটি ইউনিয়ন জুড়ে ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওর মিলে ৯হাজার ৭২৭ হেক্টর জমি নিয়ে এ টাঙ্গুয়ার হাওর। পানিবহুল মুল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার, বাকী বসতি ও কৃষি জমি। হাওরের পূর্বে ১২০টি কান্দাপার বিশিষ্ট ১৮০টি বিল ছিল। কালের বিবর্তণে ক্রমে এখন ছোট বড় ১০৯ বিলের মধ্যে প্রধান ৫৪ টি বিল। এসব বিলের ভেতর জালের মত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য খাল-নালা একটি অপরটিকে সংযুক্ত করেছে। বর্ষার সময় সব বিল মিলে একাকার হলে শুধু থৈ থৈ পানি দেখা যায়। এ হাওরকে অনেকেই বঙ্গোপসাগরের সাথে তুলনা করেন।

আর্ন্তজাতিকভাবে ঘোষিত সুন্দরবনের পর দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’ হচ্ছে, টাঙ্গুয়ার হাওর। বিশ^ব্যাপি পরিবেশ রক্ষায় সম্মিলিত প্রয়াসের নামই হলো ‘রামসার’। ১৯৭১সালে ইরানের ‘রামসার’ নগরে প্রথম বিশে^র পরিবেশবাদিদের কনভেনশনের ‘অন ওয়েটল্যান্ডস’ নামক একটি সমোঝতা স্মারক করলে ১৫৮টি দেশ স্বাক্ষর করে এবং পৃথিবীর ১৬৯ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা জুড়ে ১হাজার ৯২৮টি গুরুত্বপুর্ণ জলাভূমিকে চিহ্নিত করে তালিকাভূক্ত করা হয় এবং  পরবর্তীতে টাঙ্গুয়া হাওরও স্থান পায়। আদিকাল থেকে হাওরের মাছ, পশু-পাখি অবাধে শিকার, গাছ-গাছালি, হাওরের উদ্ভিদ এবং জীব বৈচিত্র ধ্বংস করা হচ্ছিল। ফলে ১৯৯৯সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে সংকটাপন্ন ঘোষনা করা হয়েছিল।  ২০০০সালের ২০জানুয়ারী সুনামগঞ্জের মানুষের হৃদপিন্ড টাঙ্গুয়া হাওরকে ‘রামসার’ ঘোষনা করা হয়। ২০০১ সালের ১২জানুয়ারী হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষন করার উদ্যোগ গ্রহন করা হয়। ২০০৩সালের ৯নভেম্বর থেকে সরকার সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসনের হাতে হাওরটির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। তখন থেকে দীর্ঘ কয়েকযুগের জোতদারি, জবর-দখলবাজি ও লুটপাটের অবসান ঘটে। বর্তমানে ১জন ম্যাজিস্ট্রেট এর নের্তৃত্বে ২৪জন আনসার ও স্থানীয় কমিউনিটি গাইড ও দায়িত্ব পালন করছেন।

টাঙ্গুয়ার হাওর প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে সোনা ও হীরার চেয়ে অনেক দামী। হাওরপারের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করা না হলে, হাওরের সম্পদ রক্ষা করা খুবই কঠিন। বর্ষা-শরৎকালে হাজার হাজার পর্যটক নৌকা যুগে ভ্রমন করলেও শুষ্ক মৌসুমে রাস্তার অভাবে পর্যটকরা আসতে পারেন না। সেখানে থাকা খাওয়ারও কোনও সুষ্টু ব্যবস্থা নেই। টেকেরঘাটে বিলাসবাড়ী নামে কাঠের বাড়ী থাকলেও পর্যটকদেও স্থান সংকুলান হয় না। সবমিলিয়ে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের সুবিধার্থে রাস্তা সহ হাওর এলাকার উন্নয়ন একান্ত জরুরী।
টাঙ্গুয়ার হাওর পারের ৮৮টি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বোরো ফসল ও হাওরের মাছ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা, শিলা বৃষ্টিতে ধান ক্ষতিগ্রস্থ না হলে প্রচুর ধান কৃষকের ঘরে যায়। বিলের সরকারি খাস জমির সাথে কৃষকের পুকুর ও জলাশয় রয়েছে। সেখানে কৃষকরা প্রচুর মাছ ধরে থাকেন। শীতকালে এসব মাছ ইউরোপ ও মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করা হয়। ঢাকা-সিলেট সহ দেশের অন্যান্য স্থানে মিঠাপানির এ মাছের চাহিদা অনেক বেশি।

বিলের তীরের জমিতে শীতকালে রবি শষ্যও উৎপাদন করা হয়। জলাবদ্ধতায় অনেক সময় জমি অনাবাদি থেকে যায়। বর্তমান সময়ে কৃষকরা হাওরে ফসলের চারা রোপন করছেন। এতে কিছু কিছু অতিথি পাখি হাওরের আকাশে এসে ঘুরে চলে যায়। মাস খানেক পর হাওরের পানি কমলে বা ধানের চারা সবুজ হলে খাদ্যের সন্ধানে ঝাকে ঝাকে পাখি আসবে। পাখির কিচির মিচির ডাক ও কল-কাকলিতে হাওর এলাকায় অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পাখিরা দল বেধে ফসলেরও ক্ষতি করে। শামুক ভাঙ্গরি নামে এক ধরনের পাখি দুই/তিন ফুট পানিতে প্রচুর শামুক-ঝিনুক ধরে খেয়ে থাকে। শ্রীপুর বাজার থেকে হাওর পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার রাস্তা পাকা না হওয়ায় পর্যটকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। রূপসি কন্যা টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় উন্নয়ন করা হলে পর্যটন শিল্প হবে সমৃদ্ধশালী ও উন্নত বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করবে টাঙ্গুয়ার হাওর। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত এবং জীব বৈচিত্র্যের স্বাভাবিকতা রক্ষা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যতা রক্ষায় বিল-খাল খনন সহ হাওরের উন্নয়ন জরুরী।

আমাদের পবিত্র সংবিধানে স্পটভাবে বলা আছে রাষ্ট্র, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষন ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ জীব-বৈচিত্র জলাভূমি, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। এজন্য সাংবিধানিক বাধ্যকতার আলোকেই অর্থনৈতিক উন্নতি, অবহেলিত ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং প্রকৃতি রক্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওরকে ঢেলে সাজাতে হবে। তা না হলে, বিপন্ন হবে প্রকৃতির জীব বৈচিত্র, ধ্বংস হবে মৎস্য ও বন সম্পদ, হারিয়ে যাবে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গুয়ার হাওরের ইতিহাস, ক্ষতিগ্রস্থ হবেন হাওর পারের লাখও মানুষ। সর্বোপরি এ অঞ্চলের উন্নয়ন ও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের টাঙ্গুয়ার হাওরকে সুন্দর ও আকর্ষনীয় করে তুলতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন হাওর পারের মানুষ।

লেখক,
কলামিষ্ট ও সমাজবিশ্লেষক
তারিখঃ ১৫/০১/২০২৩
মোবাঃ ০১৭১১ ৪৭৩১৫৫


শেয়ার করুন