জান্নাতুল তানভী, বিবিসি নিউজ বাংলা-
বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বুধবার থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হবে। মঙ্গলবারই শেষ হতে যাচ্ছে সব ধরনের অস্ত্র জমা দেয়ার সময়সীমা।
এর মধ্যে বিভিন্ন থানা থেকে লুটপাট করা অস্ত্র যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বৈধ অস্ত্রও।
গত ১৫ বছরে বেসামরিক জনগণকে দেয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করেছে সরকার। মঙ্গলবারের মধ্যে গোলাবারুদসহ এসব আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হামলা করে লুটপাট করা হয়। লুণ্ঠিত ওই সমস্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেয়ার শেষ সময়ও মঙ্গলবার।
তবে, থানাগুলো থেকে কি পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়েছে সে বিষয়ে পরিসংখ্যান মঙ্গলবারের পর জানানো হবে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
প্রশ্ন হলো কাদের কাছে রয়েছে এসব অবৈধ অস্ত্র? কিভাবে এই অভিযান পরিচালনা করবে যৌথ বাহিনী ?
কেন এই অভিযান ?
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন সময়েই বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার দেখা গেছে।
বিরোধীপক্ষকে শায়েস্তা করতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্রের প্রদর্শন করতেও দেখা গেছে। এসব ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয়। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে সময় ছড়িয়ে পড়ে।
এসব ভিডিওতে তাদেরকে কখনো পুলিশের সামনে আবার কখনো নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলনকারীদের দমাতে অস্ত্র হাতে দেখা গিয়েছে।
এ আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে তিন দিন রাজধানীসহ দেশজুড়ে প্রায় পাঁচশ থানায় হামলা হয়। লুটপাট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
পুড়িয়ে দেয়া হয় থানা ও পুলিশের যানবাহন। এসব ঘটনায় পুলিশের প্রায় সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে অগাস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সব থানার কার্যক্রম শুরু হয়। তবে পুলিশ এখনো পুরোপুরি কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে বলা হয়েছে, দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কমবেশি ৫০ হাজার।
রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হাতে দশ হাজারের বেশি অস্ত্র রয়েছে। এদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের সময়ে এদের অনেকেই অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন।
গত ২৫শে অগাস্ট গত সরকারের শাসনামলে দেয়া সব অস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়।
পরে গত ২৭ শে অগাস্ট থানা থেকে লুট হওয়া পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেয়ার সময়ও বেধে দেয় পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশ সদর দপ্তর কোন ব্যক্তির কাছে এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকলে মঙ্গলবারের মধ্যে নিকটস্থ থানায় জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। এ সময়ের মধ্যে কেউ এসব লুণ্ঠিত অস্ত্র জমা না দিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানানো হয়।
কত অস্ত্র লুট এবং উদ্ধারকৃত অস্ত্রের পরিসংখ্যান
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া এবং পাবলিক রিলেশন বিভাগের এআইজি এনামুল হক সাগর বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সারাদেশের থানাগুলো থেকে কত অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে, তা মঙ্গলবারের পর জানানো হবে।
“সম্প্রতি অস্ত্র ও গোলাবরুদ যেগুলো লুণ্ঠিত হয়েছে, এটি তথ্যটি আমরা প্রায় শেষ পর্যায়ে আছি। তিন তারিখে জমা দেয়ার ডেডলাইন রয়েছে, সেটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেটা(কত অস্ত্র লুট) জানিয়ে দেয়া হবে আপনাদের”।
এরই মধ্যে পুলিশের লুণ্ঠিত বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে বলেও জানান তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রতিদিন লুন্ঠিত এসব অস্ত্র উদ্ধারের পরিসংখ্যান জানানো হয়।
মি. হক জানান, পহেলা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের তিন হাজার ৮৮০ টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
গোলাবারুদের মধ্যে দুই লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৩ রাউন্ড গুলি, বাইশ হাজার ২০১ টি টিয়ার গ্যাসের সেল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া লুণ্ঠিত দুই হাজার ১৩৯ টি সাউন্ড গ্রেনেডও উদ্ধার হয়েছে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, শুধু রাজধানীর বিভিন্ন থানা থেকে এক হাজার ৮৯৮টি অস্ত্র লুট করা হয়।
এর মধ্যে গত ২৪ শে অগাস্ট পর্যন্ত ৪৫৩ টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি এক হাজার ৪৪৫টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয় নি।
এরই মধ্যে রোববার নাটোরে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি বিদেশী পিস্তলসহ এগার রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে পুলিশ।
নাটোরের পুলিশ সুপার মো. মারুফাত হোসাইন বিবিসি বাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মি. হোসাইন বলেন, “ গতকাল রাতে ব্রাজিলের তৈরি একটি সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ অবৈধ পিস্তল উদ্ধার করেছি। দুইটি ম্যাগাজিন ও এগার রাউন্ড গুলিও উদ্ধার করা হয়েছে”।
“ প্রাথমিকভাবে তদন্তে পাচ্ছি একজনের নামে লাইসেন্সকৃত। আশফাকুল ইসলাম নামে এক লোকের নামে এই পিস্তল লাইসেন্সকৃত। কিন্তু ওই পিস্তলের সাথে ৫০ রাউন্ড গুলি ছিল। কিন্তু আমরা পেয়েছি এগার রাউন্ড। তার বাসার কাছে এটি পাওয়া গেছে” বলেন মি. হোসাইন।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই ব্যক্তি পলাতক রয়েছে। এ বিষয়ে জিডি করার পর তদন্ত চলছে। তদন্তে যা পাওয়া যাবে সেই আলোকে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।
মি. আশফাকুল ইসলামের বিরুদ্ধে গত পাঁচই অগাস্ট ছাত্র -জনতার উপর গুলি করার অভিযোগ রয়েছে। পিস্তল হারিয়ে গেছে জানিয়ে গত ১৪ই অগাস্ট থানায় ইমেইল করেছিলেন তিনি।
আরো অনেক অস্ত্র পাওয়া যাবে বলে জানান এই পুলিশ সুপার।
মঙ্গলবার পর্যন্ত লাইসেন্স স্থগিত যাদের করা হয়েছে এমন অস্ত্র জমা দেয়ার সময় রয়েছে জানিয়ে মি. হোসাইন বলেন, “ আজকে পর্যন্ত ৩৫ টি অস্ত্র জমা পড়েছে। ১১৬৯ রাউন্ড গুলি জমা পড়েছে। এগুলো সব লাইসেন্সকৃত অস্ত্র”।
কিভাবে অভিযান পরিচালনা করা হবে ?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, স্থগিত করা লাইসেন্সের বিপরীতে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ থানায় জমা না দিলে উদ্ধার অভিযানে সেগুলো জব্দ করা হবে।
একই সাথে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেহাত হওয়া ও হারানো অস্ত্রসহ যে কোন অবৈধ অস্ত্র এ অভিযানে উদ্ধার করা হবে।
সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, র্যাব ও আনসারের যৌথ সমন্বয়ে অপারেশন টিম গঠন করে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
মহানগর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করবেন পুলিশ কমিশনার। সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় কমিশনার এ অভিযান পরিচালনা করবেন।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কোর কমিটির মাধ্যমে স্থগিত করা লাইসেন্সের তালিকা পর্যালোচনার ভিত্তিতে অভিযান পরিচালিত হবে। এই কমিটিতে পুলিশ সুপার, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন।
এছাড়া অবৈধ অস্ত্র সংরক্ষণ বা হেফাজতকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি জেলা তথ্য অফিস প্রচার করবে।
অভিযান ফলপ্রসূ হবে কি?
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি এনামুল হক সাগর বলেন, “ প্রজ্ঞাপনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে তিন তারিখের পরে কিন্তু সেগুলো অবৈধ অস্ত্র হিসেবে গণ্য হবে এবং অস্ত্র আইনে কিন্তু মামলা রুজু হবে। আপনাদের মাধ্যমে আহ্বান জানাতে চাই তিন তারিখের মধ্যে যাতে সকলে সব অস্ত্র জমা প্রদান করে”।
কালকের মধ্যে আরো অস্ত্র জমা পড়বে বলে আশা-প্রকাশ করেন মি. হক।
কাদের হাতে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে মি. হক জানান, অবৈধ অস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধারে একেবারেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
“ উদ্ধারে যে যৌথ অভিযান পরিচালনা হবে সেটাতেও আশা করছি একটি ভালো রিকভারি আমাদের হবে। বেশ আশাবাদী আমরা, যে যৌথ অভিযানে আমাদের বাহিনীগুলোর মধ্যে একটা সুসমন্বয়ের মাধ্যমে সেই জায়গাতে পৌছাতে পারবো”।
লুণ্ঠিত ও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ ও নিরাপত্তার আশঙ্কার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন মি. হক।
তিনি বলেন, “ আমরা নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করতে চাই। যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর কোন কিছু যেন কখনো সংগঠিত না হয় সেজন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আর অস্ত্র, গোলাবারুদ যেগুলো এখনো মিসিং রয়েছে সেগুলোতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উদ্ধারের জন্য আমরা চেষ্টা করছি, করবো ”।