ভাসানি থেকে শেখ হাসিনা : আওয়মীলীগের গৌরবের ৭৫ বছর

জাতীয় রাজনীতি সারাদেশ সিলেট
শেয়ার করুন

এ. এইচ. এম ফিরোজ আলী ::

আজ ঐতিহাসিক ২৩জুন, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। এদিন বাঙালি জাতির চরম দূর্দিনে দলটি প্রতিষ্টা লাভ করে। ইতিহাসে এ দিনটি অবিস্বরণীয় একটি দিন। ১৯৪৯ সালের ২৩জুন ঢাকার কে.এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে এ দলটি জন্ম লাভ করে। ১৭৫৭ সালের ২৩জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশির প্রান্তরে নবাব সিরাজ উদদৌলার পতন ঘটে। ২৩জুন আওয়ামীলীগের জন্মের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।

উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার পর যা কিছু এদেশের অর্জন করা হয়েছে, সবই আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে। দলের গতি-প্রকৃতি, ইতিহাস, মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক মুক্তির সংগ্রামে দলটি ওতোপ্রতভাবে জড়িত। সৃজনশীল রাজনীতির কারনে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। দলটি জাতির যে কোন আন্দোলন, সংগ্রাম, সংকট, ও দুর্যোগের পাশে দাঁড়িয়েছে দলটি। আয়ামীলীগের গৌরবময় দীর্ঘ পথে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রবল প্রতিকুল অবস্থানে থেকে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছেন, দলের লাখো লাখো নেতা কর্মীরা। নিঃস্বার্থ কর্মীদের ভালবাসায় আজও টিকে আছে দলটি। কিন্তু আওয়ামীলীগের আদর্শের কঠিন মনোভাবাপূর্ণ কর্মীরা আজ বড়ই অসহায়।

বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুকঠিন এক বাস্থবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালি নেতারা ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়মী মুসলিমলীগ, দলটি গঠন করেন। এখন এটি দেশের মানুষের মাতৃসংগঠন। বৃটিশ বেনিয়াদের বিদায়ের পর পাকিস্তানের শোষন, বঞ্চনা, অবহেলার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহি:প্রকাশই হচ্ছে, আওয়ামীলীগ প্রতিষ্টার মূল লক্ষ্য। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে করাচি নগরিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এক কর্মী সমাবেশে স্বতন্ত্র একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষনা দেন। এসময় আসাম মুসলিমলীগের সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দল ত্যাগ করে ঢাকায় আসেন এবং ঐতিহাসিক ২৩জুন মওলানা ভাষানীকে সভাপতি ও সামসছুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী মুসলিমলীগ গঠন করা হয়। কারান্তরীন বঙ্গবন্ধুকে দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ইতিহাসের কলঙ্ক, বেঈমান খন্দকার মোস্তাককে আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়। মোস্তাককে প্রথম যুগ্মসাধারণ সম্পাদক না দেয়ায় ভাষানীর সাথে তীব্রভাবে তর্ক-বিতর্কও করে ছিল খন্দকার মোস্তাক।

এদিকে নতুন দলটির গঠনের পর চরমভাবে ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠে পাকিস্তানের শাসক গোষ্টি এবং তারা সোহরাওয়ার্দী ও ভাষানীকে ভারতীয় ‘চর, বলে আখ্যায়িত করে। কিন্তু ৪০সদস্যের নতুন ওয়ার্কিংকমিটি খুব অল্প সময়ে দলটিকে শক্তিশালি করে তোলেন। শুরু হয় নেতাদের উপর পাকিস্তানের অত্যাচার নির্যাতন। ভাষানী ও সামছুল হককে এবছর ১৪অক্টোবর এবং বঙ্গবন্ধুকে ৫০সালের ১লা ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। ৫২সালের ১৬ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষনার স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন দাবিতে কারাগারের ভেতর অনশন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু । এবছর পূণরায় ভাষানী ও সামছুল হক গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫৩সালের ১৪-১৫নভেম্বর ময়মনসিংহের বিশেষ কাউন্সিলে নির্বাচনী জোট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ৫৪সালের ১০মার্চ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৭টি আসন পেয়ে জয়ী হয় যুক্তফ্রন্ট। এর মধ্যে ১৪৩টি আসন পায় আওয়ামী মুসলিমলীগ। এ নির্বাচনে মাত্র ২৪বছর বয়সে গোপালগঞ্জ আসন থেকে জয়ী হন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৫সালের ১৭জুন ভাষানী পল্টন ময়দানের ২১-২৩অক্টোবর সমে¥লনে ভাষানীকে সভাপতি, বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক এবং অলি আহমদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে নতুন ওয়ারকিং কমিটি গঠন করা হয়। এসময় দলকে অসাম্প্রদায়ীক মর্যাদার জন্য ‘মুসলিম, শব্দটি বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ’। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের কারনে দলে বিভক্তি দেখা দেয় এবং ৬৩সালে শেখ মুজিবুর রহমান দল পূর্ণ গঠনের উদ্যোগ নেন। ১৯৬৪সালে আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশকে সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক করা হলে আওয়ামীলীগের ওপর নেমে আসে আয়ুব খানের বহুমুখি নির্যাতন। ১৯৬৬সালে লাহোরে বিরুধী দলগুলোর কনভেনশনে বাংলার মুক্তির সনদ ৬দফা পেশ করেন বঙ্গবন্ধু। ৬দফা প্রচারে নেমে বাংলার মানুষের হৃদয় জয় করেন বঙ্গবন্ধু। ৬৮সালের ৩জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে ৩৫জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে এবং বিস্ফোরন মুখর পূর্ব বাংলা ৬৯সালে ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ছিনিয়ে আনেন। ২৩ফেব্রুয়ারি ১০লক্ষাধিক ছাত্র জনতা উপস্থিতিতে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৭০সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি পাকিস্তানিরা। ৭মার্চ (৭১) বঙ্গবন্ধু দুনিয়া কাঁপানো এক ভাষন দিয়ে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। ৩০লাখ শহীদ আর ৩’লাখ ইজ্জত হারানো মা বোনের কষ্টের বিনিময়ে ১৬ডিসেম্বার (৭১) বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ২৬মার্চ (৭১) গ্রেফতার হওয়া বঙ্গবন্ধু ১০জানুয়ারি ৭২সালে দেশে ফিরে আসেন। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়েও ফাঁসি দিতে সাহস পায়নি। কিন্তু ৭৫সালের ১৫আগষ্ট একদল বাঙালি বেইমানদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিতহ হন।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, ৭৪সালে কামরুজ্জামান সভাপতি, জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক এবং ৭৭সালে জোহরা তাজ উদ্দিন ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে যৌথভাবে আহবায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। ৭৮সালে মালেক উকিল সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দলের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। এসময়ের মধ্যে ক্রমাগতভাবে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, আব্দুর রাজ্জক, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজেদা চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, আব্দুল জলিল, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একসময় আওয়ামীলীগের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা এমনকি জেলা কমিটিতে লোক পাওয়া যেতনা। জাতীয় নির্বাচনে দেশের অনেক ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট থাকতনা। ২০০৯সালের পর থেকে আওয়ামীলীগে হাইব্রিড খাই খাই পার্টির কারনে দলের প্রকৃত কর্মীরা যেমন হারিয়ে যাচ্ছে তেমনি সুবিধা ভোগীরা দলের পদ পদবী দখল করে ত্যাগী নেতা কর্মীদের কোনঠাসা করে রেখেছে। ইতিমধ্যে ৭০হাজারেরও বেশি অনুপ্রবেশকারি বিভিন্ন স্থরের কমিটিতে রয়েছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেরকে ঘাড়ে ধরে দল থেকে বের করা নির্দেশ দিলেও কোন কাজে আসেনি। আওয়ামীলীগের কিছু লোভী লোক স্বার্থে অন্ধ হয়ে এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এমনি অবস্থায় দলের সাংগঠনিক কাঠামো সর্বত্র দুর্বল হয়ে পড়েছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সামাজিক উন্নয়ন করে বিরল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি সম্মান ও সাফল্যের আসন অলংকিত করেছে। এশিয়ার মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, অবকামোগত উন্নয়ন ঘরে-ঘরে বিদ্যুৎ ৩৫ধরনের ভাতা দিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। মানুষের মাথা পিছু আয় এখন ২হাজার ৬০০মার্কিন ডলার, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। ১১১টি ছিটমহলের জটিলতা মিমাংশা করে ৫২হাজার মানুষকে বন্দি দশা থেকে মুক্ত করেছেন শেখ হাসিনা। আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রের সাড়ে ১৯হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা অর্জন বিশ্বে এক ঐতিহাসিক বিজয়। বিশ্বের স্বল্পোন্নত ১৪৭টি দেশে মধ্যে মা ও নবজাতক মৃত্যু রোধ, বিশ্বের ১৬দেশের মধ্যে শিশুদের বিদ্যালয় পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম। নারী পুরুষ বৈষম্যে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০ম। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে বিনিয়োগে আকৃষ্ট ও শিল্প বিকাশে নতুন দার উন্মোচন করা হয়েছে। ডিজিটাল সেবা এখন দেশের মানুষের হাতে।

বিশ্বব্যাপি জলবায় পরির্বতন ও পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান বিশ্বমহলে প্রসংশিত হয়েছে। আওয়ামীলীগের বড় সাফল্য বাংলাদেশের স¦াধীনতা ও এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি বা দারিদ্র বিমোচন। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বঙ্গবন্ধ ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার হাত থেকে রক্ষা করতে না পারা। শেখ হসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষনা করলে ও সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। বিদেশের মাটিতে এমপি আনার হত্যা কান্ড ও সাবেক আইজিপি বেনজিরের পর্বতসম দুর্নীতি সমগ্র জাতিকে বিস্মিত করেছে এবং বিশে^ বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে। এ অবস্থার পরির্বতনে শেখ হাসিনাকে সরকার ও দলের প্রধান হিসাবে দায়ত্ব নিতেই হবে। সংগঠনটির দীর্ঘ ৭৫বছর সময়ে যারা খেয়ে না খেয়ে এ দলের অবদান রেখেছেন, জীবন দিয়েছেন, তাদের ও তাদের সন্তানদের নিশ্চই মূল্যায়ন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক, কলামিষ্ট ও জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য
এ এইচ এম ফিরোজ আলী


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *