এএইচএম ফিরোজ আলী:: বাংলা ও বাঙালি, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে সমার্থক। বরং একটি অপরটির পরিপূরক। বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন, বাংলার স্বাধীনতার মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ দেশের কাঁদা মাটিতে তাঁর জন্ম হয়েছিল বলেই, হাজার বছর পর তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু অনেক কঠিন পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে নিজের কৃতিত্বে নিজেকে অতিক্রম করেু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালির সু-খ্যাতি অজর্ন করেন। শুধু বাংলা নয়, সে সময়ের বিশে^ ২৫ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের স্বীকৃতি আদায়ে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাঙালিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৭৪সনের ২৫সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল বুধবার। জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষন দিয়ে সমগ্র বিশে^ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ও আমাদের জাতীয় জীবনে এ দিনটির গুরুত্ব অপরীসিম। বঙ্গবন্ধুর ভাষনের মাত্র ৭দিন পূর্বে ১৮সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতভাবে ১৩৬নম্বর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর ২৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌছেন। ভাষণের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার হোটেলে বঙ্গবন্ধুর সাথে স্বাক্ষাৎ করেন। ২৫ সেপ্টেম্বর সে দিন সমগ্র বিশ^বাসীর নজর ছিল জাতিসংঘের দিকে। এক রক্ত-গঙ্গা অতিক্রম করে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি ভাষণ দেন, সবার দৃষ্টি ছিল সেদিকে।
বাংলাদেশের সময় রাত ৩টায়, প্রতিক্ষিত সেই মহেন্দ্রক্ষণ। বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা মাত্রই অধিবেশন হাউসে চতুর দিকে মুহমুহ করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠে। অধিবেশনের সভাপতি আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আব্দুল আজিজ বুতাফ্লিকা আলিঙ্গন করে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে দাঁিড়য়ে তাঁর বাঙালিয়ানা স্বভাব-সূলভ ভঙ্গিতে চর্তুরদিকে তাকিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ সংস্থা ‘জাতিসংঘ’কে মানবজাতির মহান পার্লামেন্ট সম্বোধন করে বাংলা মায়ের বুলি, সেই রক্তঝরা বাংলায় ভাষণ শুরু করেন। পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে ৪৫ মিনিটের ভাষণে তিনি চমক সৃষ্টি করেন। সভাপতি ভাষণ শেষে নিজে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে শুরু করলে অধিবেশন হাউজে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
সে দিন বঙ্গবন্ধুকে ইংরেজীতে ভাষণ দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আমার বাংলায় আমি বলতে চাই। বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাঙালিকে উচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। আমাদের জাতীয় সংসদের মরহুম স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ভাই ফারুক রশীদ চৌধুরী, লন্ডনের ডেপুটি হাইকমিশনার, বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষণকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেছিলেন। তিনি নাকি ভালো ইংরেজী জানতে এবং দ্রুত অনুবাদ করতে পারতেন। তিনি দেশে ছুটিতে আসলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বেছে নিয়ে জাতিসংঘে চলে যান।
ভাষনের পর জাতিসংঘের ‘বুলেটিন, বঙ্গবন্ধুকে ‘কিংবদন্তির নায়ক শেখ মুজিব, বলে আখ্যায়িত করেন। বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, এ যাবতকালে আমরা ‘কিংবদন্তি, শেখ মুজিবের নাম শুনেছি। বক্তৃতায় ধ্বণীত হয়েছে মুজিবের মহৎ কন্ঠ। জাতিসংঘের মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ড হেইম বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। তাঁর বক্তব্য ছিল গঠনমূলক ও অর্থবহ। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহান বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে, তিনি বাস্তবিক শক্তিশালী ব্যক্তি। বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যানএল স্লেন্ড বলেছিলেন, শেখ মুজিবের মহৎ কন্ঠ আমি আবেগভরে শুনেছি। যুগোশ্লাভিয়ার উপ-রাষ্ট্রপ্রতি মিঃ মিনিক বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার ভুয়শী প্রশংসা করে বলেন, অতীতের অনগ্রসরতা, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, প্রাকৃতির বিপর্যয় ও প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষনে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেছেন। সেদিন বিশে^র অনেক নেতা, রাষ্ট্রপ্রধান বাঙালির বাংলা ভাষার স্বপ্ন দ্রষ্টার ভাষণের প্রশংসা করেছিলেন।
প্রাচীন ঐতিহাসিককালে পূর্ব ভারতে বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে আদি-অস্ট্রোলিয়, মঙ্গোলীয় পাঁচমিশালী মানুষের বাস ছিল। বাংলাদেশ ছিল, একটি ছোট অংশ মাত্র। কালক্রমে ‘বঙ্গ’ থেকে ‘বঙ্গাল, বা বাঙ্গালা বা বাংলা, সুরে বাংলা, নিজামত, ইস্ট বেঙ্গল, পূর্ব বঙ্গ, পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান নাম ছিল এ অঞ্চলের। অষ্টম শতাব্দীতে পালবংশের সময় বাঙালির রাজনৈতিক সত্তা স্বতন্ত মূর্ত হয়ে উঠলেও দক্ষিনাত্যের কর্ণাট থেকে সেনবংশ, তুর্কী, আফগান, সুলতানি শাষন, মোগল, সুবেদারী, নবাবী শাষন, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাষন, সর্বশেষ পাকিন্তানের শোষণ বাঙালিকে ভাষার প্রশ্নে বাক প্রতিবন্ধি থেকে প্রতিবাদী করে তুলে। বঙ্গবন্ধুর ভাষার জন্য জীবন তুচ্ছ করে জেলে বন্দি থাকাবস্থায় আমরণ অনশুন শুরু করে বলেছিলেন, ‘জেলের বাইরে যাবো, হয় জীবিত, না হয় মৃত্য, এটা ছিল বাংলা ভাষার দাবীতে তাঁর অঙ্গিকার’।
প্রাচীনকাল থেকে বাংলার চারটি জনপদে বিভক্ত হলেও ‘বঙ্গ, ও গৌড় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ । বঙ্গের সাথে বাংলার গভীর সর্ম্পক ইতিহাসে খুঁেজ পাওয়া যায়। সর্বপ্রথম ঐতরেয় আরণাক নামক গ্রন্থে ‘বঙ্গ, শব্দ পাওয়া যায়। রামায়ন, মহাভারত, প্রাচীণ বৌদ্ধ সাহিত্যেও বঙ্গের উল্লেখ আছে। বৈদিক যুগের শেষ ভাগে রচিত কতগুলো গ্রন্থে বাংলাদেশ মগধ, চের ও বঙ্গ এ তিনটি অঞ্চলের তথ্য পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, চীনা শব্দ আং (যার অর্থ ছিল জলাভূমি) শব্দ বদলে বং শব্দ, বং থেকে বঙ্গ শব্দের উৎপত্তি। ঐতিহাসিক আবুল ফজলের মতে, বং থেকে বঙ্গ এবং বঙ্গের সাথে আল (আইল বা জমির আইল) যোগ হয়ে বঙ্গাল হয় এবং সে শব্দ থেকে বাংলা শব্দের উৎপত্তি।
ড. মোঃ হান্নান, বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হযরত নূহ (আঃ) এর মহাপ্লাবনের পর বেঁচে যাওয়া ৪০ জোড়া নর-নারীকে বসতি ও বংশ বিস্তারের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়। হযরত নূহ (আঃ) এর পুত্র ‘হিন্দ, এর নামানুসারে হিন্দুস্তান এবং প্রপৌপুত্র ‘বঙ্গ, এর নামানুসারে বঙ্গদেশ নামকরণ হয়। ‘বঙ্গ, বংশধররাই বাঙাল বা বাঙালি নামে পরিচিতি লাভ করে। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, প্রাচীনতম জনগোষ্টি সাঁওতাল, কোল ও মুন্ডাদের এক দেবতার নাম ছিল বোঙ্গা- এ বোঙ্গা থেকে ‘বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি হতে পারে। বাংলার ইতিহাসে প্রথম প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় রাজা শসাংকের আমলে। সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শসাংক সকল জনপদকে গৌড় নামে একত্রিত করেন। সামুছুদ্দিন, ইলিয়াছ শাহ, সমগ্র বাংলাকে একটি প্রশাসনের মাধ্যমে আনার চেষ্টা করেন এবং নামকরণ করেন মূলক-ই বাঙ্গালাহ। মোগল আমলে ‘বাংলা, দেশ বাচক নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মোগল দলিলপত্রে সুবে বাংলা থেকে বাঙালা নামটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং নবাবী আমলে দেশবাচক শব্দ নামে প্রচার হয়। ইংরেজরা নাম দেয় ‘বেঙ্গল’ বা বাঙালা। ষোড়ষ, সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বণিকগণের কাগজপত্রে বেঙ্গলা, পাকিস্তান আমলে ‘ইস্ট পাকিস্তান’ নামে পরিচিত ছিল।
১৯৫৫সালের ২৫শে আগষ্ট পাকিস্তানের করাচিতে, জাতীয় সংসদে হঠাৎ মাইক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু স্পীকারকে বললেন, স্যার, আপনি দেখবেন ওরা (পাকিস্তানীরা) পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। বহুবার বলেছি, আপনারা বাংলা নামে ডাকেন। সেদিন শুধু বাংলা শব্দের জন্য পাকিস্তানের সংসদে তিনি সাহস দেখাননি, সেটা ছিল বাংলা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিদ্রোহের দুঃসাহসিকতা। ১৯৬৯সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী আলোচনা সভায় বলেছিলেন, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’। ৩মার্চ ১৯৭১ ঢাকার পল্টন ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ৭ কোটি মানুষের আবাস ভূমির নাম ‘বাংলাদেশ’। ২৬শে মার্চ রাতেও স্বাধীনতার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে ‘বাংলাদেশ’ স্বাধীন।
সাংবাদিক সিরিল ডান বলেছিলেন, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা। যিনি রক্তে বর্ণে, ভাষায়, কৃষিতে, জন্মসূত্রে একজন খাঁটি বাঙালি। তাঁর দেহ বজ্রকন্ঠ মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার বাগ্মীতা ব্যক্তিত্ব ও সাহসে তাঁকে বিরল মহানায়কে পরিণত করেছে। তিনি সর্বকালের বাংলা ও বাঙালির আপনতম কন্ঠ। স্বাধীনতা অর্জন ও বাংলা ভাষনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু উপ মহাদেশের সর্বকালের সকল শহীদদের ঋণ শোধ করেছেন। তার কর্ম সফল করেছেন, ক্ষুধিরাম, প্রীতিলতা, সূর্যসেন, ৬৯ এর আসাদ থেকে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ ৭১এর সকল শহীদদের আত্মদান। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, বংকীম, শেরে বাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দীর কঠিন সদ্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে এ দায়িত্ব নিতে হয়েছিল।
লেখক: এএইচএম ফিরোজ আলী, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক