বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন বিশ্বে নন্দিত হলেও কর্মচারিরা নিন্দিত ও অবহেলিত

Uncategorized
শেয়ার করুন

বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন কার্যক্রম বিশ্বে নন্দিত ও প্রশংসিত হলেও এ বিভাগের কর্মচারিরা সর্বক্ষেত্রে অবহেলিত ও নিন্দিত এবং বঞ্চিত। তাঁদের সরকারি ও সামাজিকভাবে তেমন কোন মূল্যায়ন নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন কার্যক্রমের সাথে জড়িত কর্মকর্তা কর্মচারিদের সরকারিভাবে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক মান-মর্যাদা দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এ বিভাগের মূল কর্মী গ্রামীণ জনগুষ্টির স্বাস্থ্য সেবক এফপিআই এবং এফডাব্লিউএদের নিয়োগবিধি হয়নি, গ্রেডও পরিবর্তন হচ্ছেনা। অথচ এ কর্মী বাহিনী মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যু রোধ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন, সংক্রামন, অসংক্রামন রোগ প্রত্রিরোধসহ প্রান্তিক জনগোষ্টির জীবনমান উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। যে কারনে পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবিরা বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন, সেনিটেশন এবং আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে পাকিস্তানকে, বাংলাদেশ হওয়ায় পরামর্শ দিয়েছেন। পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বাঙালি নোবেল বিজয়ী অর্মত্য সেন বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনার সাফল্যজনক কার্যক্রমের প্রশংসা করছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভ্যাকসীন হিরো পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ জাতিসংঘের পুরস্কার পেয়েছিলেন। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিলক্লিন্টনের স্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন বাংলাদেশে এসে ক্ষুদ্রায়তনের এদেশে পরিকল্পিত ছোট পরিবার গঠনের কার্যক্রম দেখে বিষ্মিত হয়েছিলেন। এ সাফল্য পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মচারিদের। এত সাফল্যের পরও তারা স্বাস্থ্য বিভাগের ৬০ভাগ কাজে সরাসরি সহযোগীতা করেন।
১৯৭৫ সনের ২৬শে মার্চ এক ভাষনে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘‘আমাদের ৫৫ হাজার বর্গমাইল এলাকার যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে ফ্যামেলি প্লানিং না করলে কিছুদিনের মধ্যে এদেশে কৃষি জমি আর থাকবেনা,। তাঁর এ ভাষন ছিল, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের গোড়াপত্তন। ফলে ১৯৭৬ সাল থেকে মাঠপর্যায়ে কর্মী বাহিনী নিয়োগ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর কাছে থাকা আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের ছেলে-মেয়েরা তখন দেশ রক্ষায় এই বিভাগে চাকুরিতে যোগদান করেছিলেন। এদেশের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস ও সমর্থন করেনা তাদের হাতে এ বিভাগের নারি ও পুরুষ কর্মী দীর্ঘদিন লাঞ্চিত ও অপমানিত হয়েছেন। তার পরও কর্মকর্তা কর্মচারিরা এ পর্যন্ত এ বিভাগের সাফল্য নিয়ে দেশকে আন্তজাতিকভাবে সম্মনিত করেছেন। এক সময় এ বিভাগের প্রায় ৫৫ হাজার এফপিআই এবং এফডাব্লিউএ কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৯ সালের আগ পর্যন্ত তারা উন্নয়ন খাত ভুক্ত ছিলেন। যেকারনে অনেকেই বেতন বা পেনশন না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে এ বিভাগে প্রায় মোট ৫০ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারি রয়েছেন। মাঠ পর্যায়ের কর্মী এফপিআই ও এফডাব্লিউএ চাকুরি শুরুর দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত একই পদে কর্মরত আছেন। অথচ একই মন্ত্রনালয়ের কিংবা অন্য মন্ত্রনালয়ের সমমর্যাদার পদে প্রমোশন ও গ্রেড পরিবর্তনের ব্যবস্থা রয়েছে।
২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. কাজি মস্তফা সারওয়ার সিলেটে এক সফরে আসলে মাঠ কর্মচারি সমিতি সিলেট জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ লিখিত ভাবে তাদের প্রাণের দাবি নিয়োগবিধি, ১১তম ও ১২তম গ্রেড প্রদান, কর্মচারিদের পেনশনের ২০% কর্তন বাতিল সম্বলিত স্বারকলিপি প্রদান করেন। এসময় কর্মচারিদের আবেগঘন বক্তব্য শুনে তিনি নিয়োগ বিধিও গ্রেড পরিবর্তনে কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। এর আগে কয়েক জন মহাপরিচালক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে কর্মচারিদের নিয়োগবিধি ও পদোন্নতির আশ্বাস দিয়েছিলেন। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মরহুম মোহাম্মদ নাছিমও নিয়োগবিধি প্রণয়ন পূর্বক এবিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মচারিদের পদোন্নতির আশ্বাস দিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালে এদেশের জনসংখ্যা বৃদ্দির হার ছিল ৬.৩৪ শতাংশ, ২০১১ সালে কমে দাঁড়ায় ১.৩ শতাংশ। ইউনিসেফের তথ্য মতে, ১৯৯০ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যু ছিল ১৪৯জন, ২০১৪ সালে ৩০জন এবং বর্তমানে মাতৃমৃত্যু প্রতি হাজারে ১.৯৪জন। ১৯৮০ সালে শতকরা ১ভাগ শিশু যক্ষা, ২ভাগ শিশু হামের প্রতিষেধক গ্রহণ করত। ১৯৯৫ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু ৯৫%অপুষ্টিতে ভোগছিল এবং অপুষ্টির কারনে বছরে পাঁচ লাখ শিশুর মৃত্যু ও ভিটামিন এ এর অভাবে বছরে ৩০ হাজার শিশু অন্ধ হতো। প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারী ২০০৯ সালে ৩০% ছিল। দুই বছর পূর্বে ৪৭%এ উন্নীত ছিল। বর্তমানে প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ২৪ঘন্টা ডেলিভারি ও কমিউনিটি ক্লিনিকে ডেলিভারির কারনে প্রাতিষ্টানিক ডেলিভারি অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এফডাব্লিউএগণ নবদম্পতি, মহিলাদের গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালিণ, প্রসবত্তোর সেবা, শিশুদের শাল দুধ খাওয়ানো, শিশুদের টিকাদান, কিশোর-কিশোরিদের বয়ঃসন্ধিকালীন সেবা, বাল্য বিবাহের কুফল সহ একটি সুস্থ জাতি গঠনে ঝড় বৃষ্টি রৌদ্র উপেক্ষা করে মানুষের সেবা করছেন। ডায়েরিয়া, কলেরা, আমাশয়, গুটি বসন্ত সহ পানিবাহিত ও সংক্রামক রোগ ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গি। মাঠ কর্মচারিগণ বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্যাটেলাইট ক্লিনিক, ইপিআই এনআইডি, ভিটামিন এ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট বিতরণ, সপ্তাহে ৩দিন কমিউনিটি ক্লিনিকে দায়িত্ব পালন, আদম শুমারি, খানা শুমারি, শিক্ষা, কৃষি, মৎস এবং সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বলিষ্ট ভুমিকা পালন করছেন এ বিভাগের কর্মচারিরা। তারপরও অনেক চাপ ও জবাব দিহিতা করতে হয় তাদের। তাদের পরিশ্রমের কারনে আজ পাকিস্তান ও ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনেক সুচকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর উন্নয়নের রোল মডেল।
এতো সাফল্যজনক কাজের পরও এফপিআইরা ১৬তম এবং এফডাব্লিউএগণ ১৭তম গ্রেডে রয়েছেন। অথচ একই মন্ত্রনালয়ের অধিনস্থ স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য সহকারি (এইচএ) ১৬তম গ্রেড, সহকারি স্বাস্থ্য পরিদর্শক (এএইচআই) ১৫তম গ্রেড,স্বাস্থ্য পরিদর্শক (এইচআই) ১৪তম গ্রেড, কমিউনিটি হেলথ প্রোপাইটার (সিএইচসিপি) ১৪তম গ্রেড, কৃষি বিভাগের ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত ব্লক সুপারভাইজারগন পদোন্নতি পেয়ে এখন উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা হয়ে ১১তম গ্রেড পেয়েছেন। কিন্তু বিশ্বের সর্বজন স্বীকৃত ও প্রশংসিত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যু রোধে যারা নিরলস কাজ করছেন, সেই পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডাব্লিউএ) এবং পরিবার পরিকল্পনা পরির্দশক (এফপিআই) একই অবস্থানে রয়েছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এফডাব্লিউগণ সরকারি ঘোষনা মতে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারি হলেও বেতন পাচ্ছেন চতুর্থ শ্রেণীর স্কেলে ১৭তম গ্রেডে। তারা তাদের সিলেকশন গ্রেডও পাচ্ছেন না।
দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে এদেশে প্রতি ১৩ সেকেন্ডে ১জন শিশুর জন্ম হচ্ছে। আর ১৪৪ সেকেন্ডে ১ জনের মৃত্যু হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ২ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে ১১জন বৃদ্দির বিপরিতে ১ জনের মৃত্যু হচ্ছে। প্রতি আড়াই মিনিটে মোট জনসংখ্যার সাথে ১০জন করে সংযুক্ত হচ্ছে। (২৬ মে ২০১৯ইং দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন)। বর্তমানে প্রায় ১১লাখ রোহিঙ্গাদের সাথে থাকা দম্পতিদের সাথে কাজ করছেন এফপিআই এফডাব্লিউএগণ। কর্মচারিগণ মাতার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ না করলে বর্তমান বাংলাদেশে জনসংখ্যা পরিস্থিতি ক্যামন হতো তা সহজেই অনুমান করা সম্ভব।
গত মার্চ মাস থেকে মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস হানা দেয় বাংলাদেশে। এ মরণব্যাধি ভাইরাস থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য সচেতনতা মুলক পরামর্শ ও প্রশাসনের সাথে সংযুক্ত হয়ে কাজ করছেন এফপিআই এফডাব্লিউএগণ। ইতি মধ্যে সিলেটসহ সারা দেশে বেশ কিছু এফপিআই এবং এফডাব্লিউএ করোনা ভাইরাসে আক্রন্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে তারা প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রনোদনা প্রদানের জন্য জোরালো দাবি উঠেছে। এমতাবস্থায় কর্মচারিরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে পৃথক বেতনস্কেলের মাধ্যমে আলাদা মন্ত্রনালয় করে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগকে সম্মানজনকস্থানে পৌছে দিতেন তিনি। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মচারিদের নিকটাত্নীয় আওয়ামীলীগের অনেক সিনিয়র নেতা ও মুক্তিযোদ্ধারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার জন্য কর্মচারিদের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান জটিল পরিস্থিতির কারনে কোন উদ্যোগ গ্রহন করা যাচ্ছেনা। কর্মচারিদের বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে অবহিত আছেন এবং শীঘ্রই এফপিআই এফডাব্লিদের দাবি পূরণ করে সঠিক মূল্যায়ল করবেন।
এ এইচ এম ফিরোজ আলী
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেশক
বিশ্বনাথ, সিলেট
মোবাইল ০১৭১১ ৪৭৩১৫৫


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *