এএইচএম ফিরোজ আলী :
বাংলা ভাষার স্বীকৃতি ও স্বাধীনতা অর্জন ছিল বাঙালি জাতির এক মহামুল্যবান সম্পদ। এটা ছিল বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন। এ স্বপ্নের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি মাত্র নয় মাস যুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করে বিশে^ নজিরবিহীন রেকর্ড সৃষ্টি করে। সেই বাংলা ও বাঙালিকে বিশে^ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্টিত করতে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষন দেন। বাংলা ভাষার গৌরব-ঐতিহ্য হাজার বছরের অধিক প্রাচীন। পৃথিবীতে একটি মাত্র জাতি, যারা বাংলা ভাষা ও স্বাধীনতার জন্য লাখো জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের গৌরর্বের অন্ত নেই।
১৯৭৪সালের ১৮সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে নাম ঘোষনা করা হয়। ২৩সেপ্টেম্বর ২৪সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌছেন বঙ্গবন্ধু। ২৫সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল বুধবার। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে ভাষন দেবেন, তাই বিশ্বের নজর ছিল, নিউইয়র্কের দিকে। বাংলাদেশ সময় রাত ৩টা, সেই বহুল প্রত্যাশিত ও প্রতিক্ষিত মহেন্দ্রক্ষণ। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, বঙ্গবন্ধুর নাম মাইকে ঘোষনা মাত্রই অধিবেশন হাউসের চতুরদিকে করতালি ও আনন্দ-উল্লাসে হাউস মুখরিত হয়ে ওঠে। এ সময় ঘটে যায় এক বিস্ময়কর ঘটনা। অধিবেশনের সভাপতি আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আব্দুল আজিজ বুতাফ্লিকা নিজের চেয়ার থেকে ওঠে কিছু দুর এগিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে, মঞ্চের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। বাঙালির বরণ্যে নেতাকে সেদিন এমন ভাবে বরণ করা দেখে বিশ^ চমকে ওঠে ছিল।
বঙ্গবন্ধুকে ইংরেজিতে ভাষন দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, আমার মায়ের ভাষা, বাংলায় বলতে চাই। অনুষ্ঠানে পিনপতন নিরবতা। বিশ্বের নেতাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠায় অপেক্ষমানরা ভাবছেন, কি বলবেন বাঙালির সিংহ পুরুষ? বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে চর্তুরদিকে তাকিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘকে, ‘মানব জাতির মহান পার্লামেন্ট’ আখ্যা দিয়ে বাংলায় ভাষন শুরু করেন। তাঁর ভাষনটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, আমাদের জাতীয় সংসদের মরহুম স্পীকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর ছোট ভাই তৎকালিন লন্ডনের ডেপুটি হাই কমিশনার সাবেক অর্থ প্রতিমন্ত্রী মরহুম ফারুক রশিদ চৌধুরী। তিনি ভাল ইংরেজি জানেন এবং দ্রুত অনুবাদ করতে পারেন, এমন তথ্য জেনে বঙ্গবন্ধু দেশে ছুটিতে আসা ফারুক রশীদ চৌধুরীকে সাথে করে নিয়ে যান। বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধু ৪৫মিনিট বাংলায় ভাষন দিয়ে বাঙালিকে বীরের জাতি হিসেবে সমগ্র দুনিয়ায় পরিচিত করে তুলেন। তার হয়তো মনোভাব ছিল যে, রক্তে মিশ্রিত বাংলা ভাষা বিশ^ ভান্ডারে আজীবন জীবিত থাকুক। এটা ছিল, ভাষার স্বীকৃতি ও স্বাধীনতার পর সেরা তৃতীয় অর্জন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষনে বলেন, আজ মহামহিমান্বিত সমাবেশে সন্তুষ্টির ভাগীদার, যে বাংলাদেশের সাড়ে ৭কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করিতেছি, আত্মানিন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পূর্ণতা চিহ্নিত করে বাঙালি জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে, মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগন শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন। তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সাথে শান্তি ও সৌহাদ্য নিয়া বসবাস করিবার জন্য আকাংখিত ছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষনের মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য সবদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে, সেদিন জানতে পারে, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির, স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’।
বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর জাতিসংঘের বুলেটিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কিংবদন্তির নায়ক বলে আখ্যায়িত করে। বুলোটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, এ যাবতকালে আমরা কিংবদন্তি, শেখ মুজিবের নাম শুনেছি, এ বক্তৃতায় ধ্বনিত হয়েছে, শেখ মুজিবের মহৎ কণ্ঠ। জাতিসংঘের মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়ার্ল্ড হেইম বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষনে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘গঠনমূলক ও অর্থবহ’। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহান বলেছিলেন, ‘ শেখ মুজিবর রহমানের ভাষন আমাকে মুগ্ধ করেছে, তিনি বাস্তবিক শক্তিশালি ও অসাধারন এক ব্যক্তি। বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যান এল স্লেন্ড বলেছিলেন, শেখ মুজিবের মহৎ কন্ঠ, আমি আবেগভরে শুনেছি। যুগোশ্লাভিয়ার উপ-রাষ্ট্রপতি মিস্টার মিনিক বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, অতীতের অনগ্রসরতা যুদ্ধের ধ্বংসলীল, প্রাকৃতির বিপর্যয় ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ জ¦ালাময়ী আবেবঘণ বক্তব্য বিশ্বের অনেক নেতা-রাষ্ট্রপ্রধান, নবজন্ম বাংলাদেশের স্বপ্ন দ্রস্টার ভাষনে মুগ্ধ হয়ে ছিলেন। সেদিন থেকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি, পৃথিবীর সম্মুখে বীর বাঙালি নামে পরিচিতি লাভ করে।
প্রাচীনকালে বাংলা চারটি জনপদে বিভক্ত থাকলেও বঙ্গ ও গৌড় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গের সাথে বাংলার গভীর সম্পর্ক ইতিহাসে সর্বপ্রথম। ঐতরেয় আরনাক নামক গ্রন্থে ‘বঙ্গ রামায়ন মহাভারত, বৌদি সাহিত্যেও বঙ্গের সন্ধান পাওয়া যায়। বৈদিক যুগের শেষভাগে কতগুলো গ্রন্থে বাংলাদেশ মগধ চের ও বঙ্গ তথ্য রয়েছে। চীনা শব্দ আং (যার অর্থ জলাভূমি) বদলে বং শব্দ, বং থেকে বঙ্গ শব্দের উৎপত্তি। ঐতিহাসিক আবুল ফজলের মতে, বং থেকে বঙ্গ এবং বঙ্গের সাথে আল (জমির আইল) যোগ করে বঙ্গাল হয়। এ বঙ্গাল শব্দ থেকে বাংলার উৎপত্তি। বঙ্গ+আল = বঙ্গাল মানে এ ভুখন্ডে বাংলা ভাষাভাষি ছিলেন, বলেই নাম হয় বাংলা।
দ্বাদশ শতাব্দীতে চর্যাপদে বাংলা ভাষায় রচিত গ্রন্থে কবি ভুসূকুপাদ প্রথমে উচ্চারণ করেন ‘আজি ভুসূকু বাঙালি ডইলি, – এখনকার বাংলায়, যার উচ্চারন, ‘আজকে ভুসুকু বাঙাল,। নিজেকে বাঙালি বলার দুঃসাহসিকতা অজর্ন করে ছিলেন তিনি। ষোড়শ শতাব্দীতে কবি আব্দুল হাকিম তাঁর, ‘নুরনামা গ্রন্থে লিখেছিলেন, যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবানী, ‘সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন (না) জানি,। যারা বাংলা ভাষাকে মানতে চায়না, কাব্যিক ভাষায় তাদের বলেছেন, যাদের জন্মের ঠিক নাই, তারা তো জারজ সন্তান। ড: মোঃ হান্নান, বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, হযরত নূহ (আঃ) এর মহাপ্লাবনের পর বেঁচে থাকা ৪০জোড়া নর-নারী বসতি ও বংশ বিস্তারের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরিত হলে হযরত নূহ (আঃ) এর পুত্র হিন্দ এর নামানুসারে হিন্দুস্থান এবং প্রপৌপুত্র বোঙ্গা এর নামানুসালে বঙ্গদেশ নামকরণ করা হয়। তাই বঙ্গ বংশধররাই বাঙালি। কোন কোন ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, প্রাচীন জনগোষ্ঠি সাঁওতাল কোন্ড ও মুন্ডাদের এর দেবতার ছিল, বুঙ্গা। এ বোঙ্গা থেকে বঙ্গ নামের উৎপত্তি হতে পারে।
সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাংক সকল জনপদকে গৌড় নামে একত্র করেন। সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলাকে মূলক-ই বাঙ্গালাহ নাম ব্যবহৃত করেন। মোগল আমলে বাংলা, দেশবাচক নাম প্রথম ব্যবহৃত হয় এবং দলিল পত্রে সুবে বাংলা থেকে বাঙালী নামটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নবাবী আমলে বাংলা দেশ বাচক শব্দ নামে প্রচার হয়। ইংরেজ নাম দেয়, বেঙ্গল বা বাঙলা। ষোড়ষ, সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বণিকগণের কাগজপত্রে বেঙ্গলা, পাকিস্তান আমলে ইষ্ট পাকিস্তান, যা পূর্বে পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। এটাই বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস।
বাংলাভাষার মত সুশৃংখল ভাষা সভ্যজাতির ভাষাসমূহের মধ্যে দুর্লভ। ভাষাপন্ডিতগণ মনে করেন, প্রথমত বাংলা স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণের উচ্চরণ সুনির্দিষ্ট, কোন নড়াচড়া নেই। বাংলা শব্দের উচ্চারন লিখতে হয়না। সমাজে ভিন্নতা থাকা সত্বেও বাংলা ভাষা, সব বাঙালির ভাষা। বাংলা ভাষার উন্মেষ থেকে বাঙালির সংস্কৃতির সূচনা। ১৭৭৮খ্রিস্টাব্দে ছাপা খানায় প্রথম বাংলা অক্ষর (হরফ) মুদ্রিত হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কর্মচারীদের বাংলা শিক্ষাদানের জন্য ১৮০০সালে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রথম বাংলা গদ্য পুস্তুক ছাপাও প্রকাশিত হয়।
কবি গুরু ‘রবীন্দ্রনাথ অনবরত বাংলা-বাংলাদেশ উচ্চারন করেছেন,। চর্যাপদ-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পর্যন্ত সবাই বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ও বাঙালির জন্য প্রবল অনুরাগ-আবেগ দেখিয়েছেন । কিন্তু চরম বৈরী পরিবেশেও সোনার বাংলার স্থায়ী ঠিকানা রচনা নির্মাণের দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন-একজন-ই, তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু।
প্রাচীন ঐতিহাসিককালে পূর্বভারতে বিশাল এলাকা জুড়ে আদি-অস্ট্রোলীয়-মঙ্গোলীয়-পাঁচমিশালি মানুষের বাস ছিল। বাংলাদেশ ছিল ছোট-একটি অংশ মাত্র। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পালবংশের সময় বাঙালির রাজনৈতিক সত্তা মূর্ত হয়ে উঠলেও দক্ষিণাত্বের কর্ণাট্ট থেকে সেনবংশ, তুর্কি, আফগান, সুলতানিশাসন, মোগল, সুবেদারী, নবাবীশাসন, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসন, সর্বশেষ পাকিস্তানের শোষন ও শাসন বাঙালিকে ভাষা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রতিবাদী করে তুলে। বায়ান্নতে বাংলা ভাষার দাবীতে জেলে অনশনরত বঙ্গবন্ধু, অঙ্গীকার করে বলেছিলেন ‘জেলের বাইরে যাব, হয় জীবিত না হয় মৃত,।
সর্বকালের বাংলা ও বাঙালির আপন তম কন্ঠ বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা অর্জন ও জাতিসংঘে বাংলা ভাষনের মাধ্যমে বাঙালির জাতির পিতা শেখ মুজিব উপ-মহাদেশের সর্বকালের সকল শহীদদের ঋণ শোধ করেছেন। তাঁর কর্ম সফল করেছেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, সূর্যসেন, ৬৯এর শহীদ আসাদ, ৫২এর রফিক, সালাম, বরকত, জব্বর, ৭১এর ৩০লাখ শহীদ ও ৩লাখ ইজ্জত হারানো মা-বোন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বংকিম, দেশবন্ধু, শেরেবাংলা, ভাসানী, সোহারায়ার্দীর সময়েও কঠিন সন্ধিক্ষণে, বঙ্গবন্ধুকে দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। এসব কারনেই ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ট্র বাঙালির উপাধিতে ভূষিত করে অমর ও অক্ষয় করে রেখেছে ইতিহাসে।
লেখক,
কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক