এএইচএম ফিরোজ আলী :: ইতিহাস সবসময় অমলিন, অক্ষয় ও অবিনশ্বর। চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশের অনেক নির্মম, বর্বর, লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক ঘটনাবলির মধ্যে ৩রা নভেম্বর ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত দিন। ১৯৭৫ সালের এদিন দিবাগত রাতে বাঙালিকে মেধা ও নেতৃত্ব শুন্য করতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে ফজরের নামাজের সময় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। পৃথিবীর সকল সভ্য দেশে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনে থাকা কারাগা নিরাপত্তা সবচেয়ে নিরাপদ থাকে। কিন্তু জাতীয় চার নেতাকে জেলের অভ্যন্তরে হত্যা করায়, সেদিন বিশ্ব স্তম্ভিত হয়েছিল। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এ হত্যাকান্ডের মুল কারন। ১৯৭৫সালের ১৫আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার ২মাস ১৯দিন পর মুক্তিযুদ্ধের চার সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও সহচর বর্শিয়াণ রাজনীতিবিদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমদ, ক্যাপটেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। ক্ষমতালোভী বিশ্বাস ঘাতক খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জাতীয় এ চার নেতাকে তাঁর মন্ত্রীসভার যোগদানের আহবান করলে তাঁরা ঘৃনাভরে প্রত্যাখান করেন। এতে পাল্টা আক্রমণ এড়াতে ২২আগষ্ট এ চার নেতাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। রাষ্ট্রের রক্ষক বক্ষক হয়ে মানবতা বিরুধী এ হত্যাকান্ড ঘটিয়ে বিশ্বে বাঙালিকে হেয় পৃতিপন্ন ও কলঙ্কিত করে। আজ জেল হত্যাকান্ডের ৫০তম দিবস।
ঐতিহাসিক তথ্যমতে, ১৯৪৯সনের ২৩জুন আওয়ামীলীগ প্রতিষ্টার দিনে ভাষা আন্দোলনের কারনে বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। মাওলানা আব্দুল খান ভাসানি জেলে থাকা বঙ্গবন্ধুকে দলের প্রথম যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মনোনীত করায়, খন্দকার মোশতাক চরম ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে ভাসানির সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং উচিৎ শিক্ষা দেয়ারও হুমকি দিয়ে ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুজিব নগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থাকাবস্থায় কলকাতায় মোশতাক পকিস্তানের ভুট্টোর কুপরামর্শ্যে জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি রেফারেন্ডাম করে যুদ্ধ বিরতির চেষ্টাও করেছিল। প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ মোশতাকের এ ফাঁদে পা দেননি। যে কারনে ১৫আগষ্ট ও ৩রা নভেম্বর হত্যাকান্ডের সাথে মোশতাক সরাসরি জড়িত থাকার অনেক দালিলিক প্রমান বিদ্যমান।
৩রা নভেম্বর দিনটি ছিল সোমবার, দিবাগত রাত অনুমান দেড়টার সময় একটি জিপে একদল সেনা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে নেমে ভেরতে প্রবেশ করে জেলারের নিকট একটি কাগজ দেয়। এসময় খন্দকার মোশতাক টেলিফোনে জেলারকে বলেন, ‘সেনা অফিসাররা যা চায় সেটা তুমরা করবা’। সকল প্রস্তুতি শেষে ভোররাতে যখন চর্তুরদিকের মসজিদে মোয়াজ্জিন আযান দিচ্ছেন, ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ অর্থাৎ ঘুম থেকে নামাজ উত্তম। এসময় মুমিন-মুসলমানরা নামাজের জন্য মসজিদের দিকে রোয়ানা হলে ঘাতকরা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা শুরু করে। তারা লাইট মেশিনগান ও ভেয়োনেট দিয়ে জাতীয় চার নেতাকে হত্যাশুরু করে। তাজউদ্দিন আহমদ গ্রেনেড চার্জের পর কিছু সময় বেঁছে ছিলেন। তিনি পানি পানি বলে চিৎকার করলে, পানি না দিয়ে পূণরায় বেয়োনেড দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে তাঁর দেহ ঝাঝড়া করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। এভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে স্বাধীনতার প্রতিশোধ নেয় ঘাতক চক্র। ২০১০সালে তৎকালিন জেলার আমিনুর রহমান বিবিসিকে দেয়া এক স্বাক্ষাৎকারে এবং ব্রিগেডিয়ার (অব:) এম শাখাওয়াত হোসেন এর বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় শিরোনামে বইয়ে এসব তথ্য রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার বাণিজ্যমন্ত্রী স্বঘোষিত খুনি রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক, আতœস্বীকৃত খুনি কর্ণেল (অব:) সৈয়দ ফারুক রহমান লে: কর্নেল (অব:) আব্দুর রশিদ, জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ৫সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছিল। রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন সৈয়দ ফারুক রহমানের সবচাইতে বেশি আস্তাভাজন হওয়ায় তাকে ঘাকত দলের প্রধান করা হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনী মাসকারেনহাস তাঁর বাংলাদেশ লিগ্যাল ব্লাড গ্রন্থে, এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। প্রখাত লেখক গোলাম খুরশিদ তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও তার পর, বইয়ে বলেছেন, খন্দকার মোশতাক জেল হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন, কেবল মাত্র বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রশিদকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যাতে পাল্টা কোন অভ্যুত্থান না হয়, তার জন্য এ চারজনকে জেলের ভেতরে হত্যা করে সবকিছু থমকে দেয়া হয়।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯২৫সালে কিশোরগঞ্জে যষোদল দাশপাড়ায় জন্মগ্রহণ করে, স্কুল-কলেজ জীবন শেষে ১৯৪৭সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ, ৫৩সালে এলএলবি পাশ করেন। ৫৪সালে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সহসভাপতি, ৫৭সালে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি, ৬৬-৬৯সালে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ৭১সালে ২৫মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পর পূণরায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং ১৭এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের শিল্প মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ৫২সালে ভাষা আন্দোলনে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য এবং ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় অগ্রনী ভুমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তাজউদ্দিন আহমদ ১৯২৫সালে গাজীপুরের চর দরিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করে ৪৮সালে ছাত্রলীগ প্রতিষ্টার উদ্যোগতা এবং ৫২সালে ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন। ৫৩সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ¯œাতক, ৬৪সালে কারাবন্ধি থাকাবস্থায় পরিক্ষায় অংশ নিয়ে আইন শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন এবং ৬৬সালে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও স্বাধীনতার প্রথম সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে প্রথম বাজেট ঘোষনা করেন। এম মনসুর আলী ১৯১৯সালের ১৬জানুয়ারি সিরাজগঞ্জের রতনকান্দি ইউনিয়নের কুড়ি পাড়ায় জন্ম গ্রহণ করে ১৯৪৫সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং এলএলবি পাশ করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এএইচএম কামারুজ্জামান ১৯২৬সালের ২৬জুন নাটোরের নুরপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫৭সালে রাজশাহী জেলার আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক, ৭৪সালে আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি, ত্রাণ ও পূণ:বাসন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব সুনামের সহিত পালন করেছিলেন।
হত্যাকান্ডের পরদিন চার নভেম্বর তৎকালীণ উপ-কারা পরিদর্শক কাজি আব্দুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়েরের পরের দিন আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান হাওলাদার স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে হত্যাকান্ড সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। ৩নভেম্বর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্টিত খন্দকার মোশতাক ও তার দেশি-বিদেশি সহযোগীরা বাঁধার সৃষ্টি করে বিচারকার্য থমকে দিয়েছিল। হত্যাকান্ডের দীর্ঘ ২১বছর পর ৯৬সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর জেল হত্যকান্ডের মামলাটি পূনরুজ্জীবিত করা হয়। তখন সিআইডির এএসপি আবুল কাহার আকন্দকে তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করলে, তিনি তদন্ত শেষে ১৯৯৮সালের ১৫অক্টোবর ২০জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জসীট দাখিল করেন। বিচার কাজে কোন রকম প্রভাব ছাড়া ২০০৪সালের ৪অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো: মতিউর রহমান নির্মম এ হত্যাকান্ডের রায়ে দন্ডবিধির ৩০২/৩৪ধারামতে, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধা এ তিন জনকে মৃত্যুদন্ড এবং ৩০২/১০৯ধারামতে, ১২জনকে যাবৎজীবন কারাদন্ড দিয়ে ৫জনকে খালাস প্রদান করেন। যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত আসামি খন্দকার আব্দুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, এএইচএমবি নুর রশিদ, এমএ রাশেদ চৌধুরী, আব্দুল মাজেদ, আহমদ শরিফুল হোসেন, কিসমত হোসেন, নাজমুল হোসেন আনছার, সৈয়দ ফারুক রহমান, সাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা এবং একেএম মহিউদ্দিন। খালাসপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি, সাবেক মন্ত্রী কেএম ওবাদুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জু, তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মেজর (অব:) খায়রুজ্জামান। ২০০৮সালের ২৮আগষ্ট মহামান্য হাইকোটের রায়ে শুধুমাত্র রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে, দফাদার মারফত আলী ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে খালাস প্রদান করেন। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মুল নায়ক লে: কর্ণেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে: (অব:) শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব:) বজলুল হুদা ও মহিউদ্দিনকে খালাস প্রদান করায় পুরো দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ২০১৩সালের ৩০এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোটের রায় বাতিল করে নি¤œ আদালতের রায় বহাল রাখেন এবং সেই রায় ২০১৫সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়।
২০১০সালের ২৭জানুয়ারী গভীররাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি লে: কর্নেল (অব:) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে: কর্নেল (অব:) শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব:) বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছিল। ২০২০সালের ১২এপ্রিল জেল হত্যা মামলার বিদেশে থাকা পলাতক আসামি আবুল মাজেদকে দেশে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। এ মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও আবুল হোসেন মৃধা, যাবৎজীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি খন্দকার আব্দুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, এএইচএম নুর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরিফুল হোসেন, কিছমত হোসেন, নাজমুল আনসার এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। জেল হত্যাকান্ডে বিচারে জাতি কলঙ্কমুক্ত হলেও ফাঁসির রায় কার্যকর হয়নি।
এএইচএম ফিরোজ আলী
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক