ইতিকাফ একটি মহান ইবাদত। ইতিকাফ হচ্ছে ইমানি শিক্ষা গ্রহণের একটি শিক্ষনীয় পবিত্র পাঠশালা। ইতিকাফ ইমান মজবুত করে এবং বান্দা মোত্তাকি হওয়ার মহা সূযোগও বটে। মাহে রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে (পুরুষ) অবস্থান করতে হয়। ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। গ্রাম-মহল্লা ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে রোজাদার কেউ ইতিকাফ করলে সুন্নতে কিফায়া আদায় হয়ে যায়। কিন্তু যদি কেউ ইতিকাফ পালন না করেন, তবে সবাই গোনাহগার হবেন। সূরা বাকারার ১২৫তম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইতিকাফ সম্পর্কে বলেছেন, “আর আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈল কে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে (কাবা শরীফ) তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী রুকু ও সেজদাহকারীদের জন্য পবিত্র
রাখো”।
স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ইতিকাফের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। নবী করিম (স.) ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যাক্তি রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করবে, তার জন্য দুই হজ্জ ও দুই ওমরাহ হজ্জের সওয়াব রয়েছে (রায়হাকি)”। অপর এক হাদিসে রাসূলূল্লাহ (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিনের ইতিকাফ করলো, আল্লাহ পাক তার ও দোজখ এর মধ্যখানে এমন তিনটি পরিক্ষা তৈরি করে দেবেন, যার একটি থেকে অপরটির দূরত্ব হবে পূর্ব ও পশ্চিমের চেয়ে বেশী (তিরমিযি ও রায়হাকি)”।
ইতিকাফ শব্দের অর্থ হচ্ছে, অবস্থান করা, স্থির থাকা, বা আবদ্ধ থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় রমজানের শেষ দশ দিন বান্দা তার দুনিয়ার সব কাজ ত্যাগ করে একমাত্র মহান আল্লাহকে সন্তুষ্টির জন্য নিয়ত করে মসজিদে (পুরুষ) বা ঘরের পবিত্র যে কোন স্থানে (মহিলা) অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ তিন ধরনের ১.ওয়াজিব ২.সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ৩.মুস্তাহাব। কেউ ইতিকাফ পালনের মানত করলে সেই ইতিকাফ পূরণ করা ওয়াজিব।
আর এলাকাবাসীর পক্ষে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। রমজানের শেষ দশ দিন ছাড়া অন্য সময়ে ইতিকাফ করা মুস্তাহাব। পুরুষরা মসজিদে, নারীরা ঘরের নির্দিষ্ট যে কোন পবিত্র কোণে ইতিকাফ পালন করতে পারবেন। বিশ রমজান সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে ইতিকাফকারী প্রবেশ করতে হবে এবং ঈদের চাঁদ দেখা গেলে ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করতে হয়। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ” রাসূল (সা.) দুনিয়ায় যত দিন জীবিত ছিলেন, তিনি ততদিন রমজানের শেষ দশক মসজিদে ইতিকাফ করেছেন।
যে বছর নবীজী জগৎ থেকে বিদায় নেন সেবছর ও তিনি বিশ দিন ইতিকাফ করেছেন (বুখারী ও মুসলিম)। মুসলিম শরীফে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) এর অপর এক বর্ননায় এসেছে, ” নবী করিম (সা.) বলেছেন, আমি লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও মহিমা অনুসন্ধানের জন্য রমজানের প্রথম ও মাঝের দশদিন ইতিকাফ করেছি”। অবশেষে আমার কাছে এসে একজন ফেরেশতা জানালেন,”লাইলাতুল কদর শেষ দশকে”। লাইলাতুল কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সুতরাং ইতিকাফের প্রধান অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদর লাভ করা। এ রাতেই নবী করিম হযরত মুহাম্মদদের উপর মহাগ্রন্থ আল-কোরান নাযিল হয়েছিল। বিশ রমজানের পর যে কোন বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওফাতের পর তাঁর বিবিগণ নবী করিম (সা.) এর নিয়ম অনুসরণ করে ইতিকাফ করতেন (বুখারী ও মুসলিম)। স্ত্রীলোকের মসজিদে ইতিকাফ করা মাকরুহ। ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে যেখানে তিনি নামায আদায় করবেন, সেখানেই ইতিকাফ করবেন। ইতিকাফ গুনাহ মাফের সূযোগ থাকলে ও ইতিকাফকারীদের জন্য কঠোর হুশিয়ারী রয়েছে।
হাদিস শরীফে বর্নিত আছে, ” রাসূলূল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “ইতিকাফকারী রোগী দেখতে যেতে পারবেন না, জানাযায় উপস্থিত হবেন না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবেন না। বিশেষ জুরুরী কাজ ব্যতীত মসজিদের বাইরে যাবেন না (মুসলিম ও আবু দাউদ)। পস্রাব পায়খানার জন্য বের হলে এক সাথে ওযু গোসল ছেড়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। ইতিকাফকারী নির্দিষ্ট কিছু প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। ইতিকাফকারী যে মসজিদে অবস্থান করবেন, সে মসজিদে যদি জুমার নামায পড়া না হয়, তবে অন্য মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করতে পারবেন। কিন্তু কারো সাথে কথা বলা যাবেনা। ইতিকাফকারী কাউকে সালাম দিবেন না। তবে কেউ সালাম করলে উত্তর দিতে পারবেন। মসজিদে ইলম ও কোরআন শিক্ষা দিতে পারবেন। ইতিকাফকারী নফল নামায, কোরআন তেলাওয়াত, দরুদ শরীফ, জিকিরের মধ্যে মগ্ন থেকে দুনিয়ার সব কাজ কর্ম ভুলে যাওয়া। ইতিকাফকারী নিজের প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়, থালা-বাসন মসজিদে নিতে পারবেন এবং মসজিদের যেকোনো পাশে নিজের কাপড় টাঙ্গিয়ে অবস্থান করবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে ফরয নামাযের যেন কোনো অসুবিধা না হয়। কিংবা মসজিদের আদবের কোনো বিঘœ না ঘটে।
ইতিকাফের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। বান্দা তার পাপ মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে বিনয়ে ক্ষমাপ্রার্থী হয়। দশদিন শুধু আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকায় বান্দার ধৈর্য্যের গুণ সৃষ্টি হয়। এবং খোদাভীতি বাড়ে। বর্তমান সময়ে মহামারি করোনার কারণে মসজিদে নামায পড়া সীমিত ছিল। আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দশদিন ইতিকাফ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে পাপ মুক্ত হব আমিন।
লেখক, কলামিস্ট ও সমাজবিশ্লেষক
এ এইচ এম ফিরোজ আলী